জানাযার নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও দোয়া

 

প্রত্যেক প্রানীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করিবে। তাই সর্বদাই মৃত্যুকে স্মরণ রাখা ও দেনা-পাওনার হিসাবপত্র সঙ্গে রাখা মােস্তাহাব। হাদীছে আছে, যাহারা মউতকে দৈনিক বিশবার স্মরণ করিবে, মৃত্যুর পর তাহারা শহীদের দরজা পাইবে। লােকের শরীরে কোন রােগ হইলে রীতিমত তাহার চিকিৎসা করান ছুন্নত। কোনও রােগে অত্যন্ত কাতর হইয়া যদি তাহার চক্ষু, হাত ও পায়ের তাল কিংবা গাল দুইটি দাবিয়া যায় অথবা নাক, কান, হাত ও পায়ের জোড়াসমূহ ঢিলা ঢিলা হইয়া যায়, তখন বিবেচনা করিতে হইবে যে, তাহার মৃত্যুর সময় অতীব নিকটবর্তী হইয়াছে, সুতরাং তখন তাহার সঙ্গ ছাড়া থাকা উচিৎ নহে। যখন মুমূর্ষ সময় হইবে তখন নিকটস্থ লােক তাহাকে শরবত, পানি দিৰে ও উচ্চৈঃস্বরে কলেমা শাহাদাত পাঠ করিতে থাকিবে ও তাহার মুখ পশ্চিম-রােখ করিয়া দিবে। আজ আমরা জানাযার নামাজ, জানাযার নামাজের নিয়ম, জানাযার নামাজের নিয়ত, জানাযার নামাজের দোয়া ও ফজিলত সর্ম্পকে জানবো।

জানাযার নামাজের নিয়ম

জানাযার নামাজের নিয়ম

  প্রত্যেক জিনিষেরই একটা সুন্দর নিয়ম থাকে। এখানে জানাযার নামাজের নিয়ম সমূহ আলোচিত হল। জানাযা নামাযের নিয়্যত করিয়া প্রথমে তাকবীর বলিবার সময় কান পর্যন্ত হাত উঠাইতে হয়, তৎপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তাকবীর বলিবার সময় হাত উঠাইতে হয় না। কিন্তু সমস্ত তাকবীর গুলিই উচ্চৈঃস্বরে বলিতে হইবে ; মসজিদে জানাযার নামায পড়া মাকরূহ। জানাযার নামায ব্যতীত কোন মুর্দাকে দাফন করিলে তিন দিন পর্যন্ত তাহার গােরের উপর জানাযার নামায পড়া যায়। (মৃত সন্তান ভূমিষ্ঠ হইলে তাহার জানাযার নামায পড়িতে হয় না)। এই নামাযে রুকু ছেজদা নাই, দাড়াইয়া পড়িতে হয়।

জানাযার নামাযে দুইটি ফরজ মাত্রঃ

১। দাঁড়াইয়া পড়া,

২। তাকবীর বলা।

 

 

মৃত্যুর পর করনীয়

আর যখন মৃত্যু হইবে তখন তাড়াতাড়ি তাহার চক্ষু বন্ধ করিয়া দিবে ও হাত পা টানিয়া সােজাভাবে রাখিয়া দিবে এবং (লম্বা) দাড়ি থাকিলে বান্ধিয়া দিতে হইবে। তৎপর মাছলা-মাছায়েল জানা ব্যক্তির দ্বারা গােছল দেওয়াইবে। কাফন ও জানাযা অন্তে সত্বর দাফনের ব্যবস্থা করিবে বা করাইবে। স্ত্রীলােক স্ত্রীলােককে এবং পুরুষলােক পুরুষলােককে গোছল দেওয়া কর্তব্য মনে করিবে।

 

 

মৃত ব্যক্তির গোসল

  মুর্দাকে গােছল দেওয়া ফরজে “কেফায়াহ”। হযরত আদম (আঃ) হইতে মুর্দাকে গােছল দেওয়ার নিয়ম হইয়া আসিয়াছে। হযরত আদম (আঃ)এর ইন্তেকালের পর হযরত জিব্রাইল (আঃ) বেহেশতের কাফন, সুগন্ধি ও অন্যান্য ফেরেশতাকে সঙ্গে লইয়া কাফুর ও বরই পাতা সিদ্ধ পানি দ্বারা তাহাকে তিনবার গােছল দিয়া তিন কাফনে “লহদ কবর” খুদিয়া দাফন করিয়া আওলাদে আদমকে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, এ রেওয়াজ কেয়ামত পর্যন্ত তােমাদের উপর ওয়াজিব ম্বরূপ থাকিয়া গেল।

 

মুর্দা দুই প্রকার। এক প্রকার গােছল দিতে হয়। দ্বিতীয় প্রকার গােছল দিতে হয় না। গােছল আবার দুই কারণে দিতে হয়। প্রথম কারণ, জানাযার নামায পড়িবার জন্য, সর্বসাধারণ মুসলমানের মৃত্যু হইলে গােছল দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, মুসলমানীর সম্মানার্থে, যেমন মরা শিশু ও কাফের হরবী। গােছল না দেওয়ারও দুই কারণ। ১ম- ঘৃণা করিয়া গােছল না দেওয়া। যথাঃ– ইসলামের বিরুদ্বে যুদ্ধ করিয়া ও ডাকাতি করিতে গিয়া মারা গেলে । ২য়- তমীজ ইজ্জত করিয়া গােছল না দেওয়া। যথা – শহীদ মুর্দাকে ওযু করাইয়া সঙ্গে সঙ্গে মুর্দার ছের মােছহ করা ও পা ধৌত করিয়া দেওয়া কর্তব্য। স্ত্রী-মুর্দার গােছল পুরুষ মুর্দার ন্যায়ই বটে। গােছলের সময় তাহাদের লম্বা লম্বা চুলগুলিকে ছিনার উপর রাখিয়া দিতে হইবে। 

 

মুর্দাকে কোনও উচ্চস্থানে খাট বা তক্তার উপর রাখিয়া গােসল দেওয়া মােস্তাহাব। সামান্য কোন একটি ভারী বস্তু মুর্দার পেটের উপর রাখিয়া দিলে মুর্দার শরীর ফুলিয়া উঠিবে না। (কালামুল্লাহ্ রাখা দুরস্ত নাই) জুনুব ও হায়েজ নেফাছওয়ালী স্ত্রীলােক মুর্দার নিকট যাওয়া দুরস্ত নাই। স্বামীর মৃত্যু হইলে তাহার স্ত্রী তাহাকে দেখিতে পারিবে ও ছুঁইতে পারিবে এবং গােছলও দিতে পারিবে। আর স্ত্রীর মৃত্যু হইলে স্বামী তাহাকে (স্ত্রীকে) দেখিতে পারিবে। কিন্তু ছুঁইতে ও গােছল দিতে পারিবে না।

 

 

মৃত ব্যক্তির হাদিয়া বা কাফফারা

কোন লােক মরিয়া গেলে তাহার জিম্মায় ফরজ নামায, ফরজ রােযা, কছমের কাফফারা, তেলাওয়াতে-ছেজদা, ছােহ-ছেজদা ও ফরজ ওয়াজেব নামায, রােযা ইত্যাদি থাকিলে ঐ সমস্তের কাফফারা আদায় করা একান্ত আবশ্যক। যদি না পারা যায় তবে এক জেল্দ কোরআন শরীফ তাহার ঐ সমস্তের জন্য হাদিয়া করিয়া দেওয়া কর্তব্য। যেহেতু তদুছিলায় আল্লাহ তাআলা তাহাকে মাফ করিয়া দিতে পারেন।

 

 

 

জানাযার নামাজের নিয়ত

জানাযার নামাজের নিয়ত

জানাযার নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণঃ নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহি তাআ’লা আরবায়া’ তাকবীরাতি ছালাতিল জানাযাতি ফারজুল কিফা-য়াতি আচ্ছানাউ লিল্লা-হি তাআ’লা ওয়াচ্ছালা’তু আলান্নাবিয়্যি ওয়াদ্দোয়াউ লিহাজাল মাইয়্যিতি মােতাওয়াজ্জিহান ইলা-জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।

জানাযার নামাজের নিয়তের অর্থ: আল্লাহর উদ্দেশ্যে কা’বা শরীফের দিকে মুখ করিয়া জানাযার নামায চারি তাকবীর সহ আদায় করিতে মনস্থ করিলাম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর উপযুক্ত এবং আমাদের নবীর উপর শান্তি ও এই মৃত ব্যক্তির উপর আশীর্বাদ হউক, আল্লাহ মহান।।

নিয়্যতান্তে প্রথমে তাকবীর (আল্লাহু আকবার) বলিয়া সানা/ ছুবহানাকা পড়িবে।

সানার বাংলা উচ্চারণ : ছুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাছমুকা ওয়া তাআলা জাদুকা ওয়া লা-ইলাহা গাইরুকা।

কেবল ছুবহানাকার মধ্যে ওয়া তাআলা জাদুকার’ পরে ‘ওয়া জাল্লা ছানাউকা’ বৃদ্ধি করিয়া বলিতে হয়।

 ছুবহানাকা পড়িয়া দ্বিতীয় তাকবীর বলিবে। তৎ-পর দরূদ পাঠ করিয়া তৃতীয় তাকবীর বলিবে। 

 

দুরুদ শরীফ

দুরুদ শরীফ

 

দুরুদ শরীফ বাংলা উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা ছাল্লাইতা আলাইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামিদুম্মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিঁও ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ।।

দুরুদ শরীফ এর অর্থ: হে আল্লাহ! মােহাস্মদ (সঃ) এর উপর ও তাহার বংশধরের উপর দরূদ (আশীর্বাদ) পাঠাও, যেরূপ আশীর্বাদ ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁহার বংশধরের উপর পাঠাইয়াছিলে। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও জ্ঞানী। হে আল্লাহ! মােহাম্মদ (সঃ) ও তাহার বংশধরের উপর বরকত পাঠাও, যেরূপ বরকত ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁহার বংশধরের উপর পাঠাইয়াছিলে। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও অভিজ্ঞ।

 

জানাজার নামাজের দোয়া

আর মুর্দা বালেগা (বয়স্কা স্ত্রী বা বয়স্ক পুরুষ) হইলে তৃতীয় তাকবীরের পরে নিম্নলিখিত দোয়া পড়িয়া চতুর্থ তাকবীর বলিবে।

জানাযার নামাজের দোয়া

জানাযার নামাজের দোয়া বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগ্ ফিরলিহাইয়্যিনা, ওয়া মাইয়্যিতিনা, ওয়া শাহিদিনা, ওয়া গায়িবিনা, ওয়া ছাগীরিনা, ওয়া কাবীরিনা, ওয়া জাকারিনা, ওয়া উন্ছানা; আল্লাহুম্মা মান আহ্ইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহী’ আলাল, ইসলামি ওয়া মান্ তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ্ফাহু আলাল ঈমান; বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।

জানাযার নামাজের দোয়ার অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, কনিষ্ঠ ও বৃদ্ধ, পুরুষ ও স্ত্রীলােক সমস্তকে মার্জনা কর । হে আল্লাহ! আমাদিগের মধ্যে যাহাদিগকে জীবিত রাখ তাহাদিগকে, ইসলামের অন্তর্ভুক্ত রাখিও এবং যাহাদিগকে মৃত্যু দান কর, তাহাদিগকে ঈমানের সহিত মৃত্যু দান করিও ; তােমারই অনুগ্রহে, হে সর্বশ্রেষ্ঠ করুণাময়!

 

আর যদি মুর্দা নাবালেগ ছেলে হয় তবে তৃতীয় তাকবীরের পরে উক্ত দোয়া না পড়িয়া নিম্নলিখিত দোয়া পাঠ করিয়া চতুর্থ তাকবীর বলিবে ও ছালাম ফিরাইবে । যথাঃ

 

বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজ্ আ’ল্হুলানা ফারতােয়াও ওয়াজ আ’ল্হু লানা আজরাঁও ওয়াজআল্ হু লানা জুখরাঁও ওয়াজ্আল্হু লানাশাফিয়াঁ’ও ওয়া মুশাফ্ফায়া।

অর্থ: হে আল্লাহ! উহাকে আমাদের অগ্রগামী কর এবং আমাদের জন্য পুণ্য সঞ্চয়কারী এবং আমাদের জন্য অনুরােধকারী ও প্রার্থনাকারী কর ।

 

আর যদি মুর্দা নাবালেগ মেয়ে হয় তবুও তৃতীয় তাকবীর বলিয়া উল্লিখিত দোয়া পাঠ করিয়া ৪র্থ তাকবীর বলিবে। কেবলমাত্র বিভিন্নতা এই যে, উক্ত দোয়ার মধ্যে যে যে স্থলে ‘হু’ ‘হু’ আছে সে সে স্থলে ‘হা’ ‘হা’ বলিতে হইবে।

আজআ’লহু স্থলে আজআ’লহা এবং শাফিয়াঁ’ও ওয়া মুশাফ্ফায়া’ স্থলে শাফিয়া’তাঁও ওয়া মুশাফ্ফায়া’তা বলিতে হইবে। আর ইহাও জানিয়া রাখিবে যে, মুর্দা (প্রাপ্তবয়স্ক হউক কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হউক) স্ত্রীলােক হইলে নিয়্যতের মধ্যে লিহাজাল মাইয়্যিতি স্থলে লিহাজিহিল মাইয়্যিতাতি বলিতে হইবে।

 

জানাযার নামাজের ফজিলত

জানাযার নামাজের ফজিলত অপরিসীম। জানাযার নামাজ যেহেতু ফরজে ‘কেফায়া’ সেহেতু সমাজের কিছু ব্যক্তির উপস্থিতিতে আদায় হয়ে যাবে। তারপরও আমাদের ঈমানী দায়িত্ব হচ্ছে জানাযায় অংশগ্রহন করা। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, জানাযায় অংশগ্রহন করবে সে ওহুদ পাহাড় পরিমান সওয়াবের অংশীদারি হবে।

আজ আমরা এ আালোচনায় জানাযার নামাজের নিয়ম, জানাযার নামাজের নিয়ত, জানাযার নামাজের দোয়া ও ফজিলত সম্পকে জানলাম। যদি আপনার কাছে নূন্যতম ভালো লেগে থাকে সেটাই আমাদের স্বাথকতা। যদি ভালো লেগে থাকে বন্দুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আর কিছু বলার থাকলে কমেন্ট বক্সে কমেন্টস করুন। আল্লাহ হাফেজ।।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!