রমজানের ফজিলত

বছর গুরে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত নিয়ে আবারও এসেছে পবিত্র রমজান মাস। সংযমের মাস পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। মাহে রমজান আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। রমজানের ফজিলত এর কথা বলে শেষ করা যায় না।

ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ সাওম, বহুবচন সিয়াম। সাওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী আইনে রোজা হল আল্লাহর আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার এবং স্ত্রীর সাথে সহবাস করা থেকে বিরত থাকা।

২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোযার ফরজ সম্পর্কে একটি আয়াত নাযিল হয়ঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা সংযমী হতে পারো। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)।

সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসটি পাবে, সে যেন রোজা রাখে।”

রমজানের ফজিলত

রমজানের ফজিলত

 

পবিত্র রমজান মাসের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে কিতাবে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো-

প্রিয় নবী (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং শয়তান শৃঙ্খলিত হয়। (বুখারী, মুসলিম)

অন্য হাদিসে হজরত শাহ ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জান্নাতের ছয়টি দরজা রয়েছে। একটি দরজার নাম রাইয়ান। সে দরজা দিয়ে রোজাদার ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)

এ মাসে অনেক ফজিলত রয়েছে এবং পবিত্র কোরআন হাদিসে এর ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ফজিলত এখানে তুলে ধরা হলো।

 

‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো: আল-কুরআন।

রমজান মাসে নেক আমলের প্রতিদান বহুগুণ বেড়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি নফল ইবাদত করল, সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি রমজানে একটি ফরজ পালন করবে, সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ পালন করলো। (ইবনে খুযায়মাহ)

 

নিন্মে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস উল্লেখ করা হলঃ

১। ফেরেশতারা ইফতার পর্যন্ত রোজাদারদের জন্য দোয়া করেন’: আল-হাদিস।

২। রোজাদারদের জন্য প্রতিদিন জান্নাত সাজানো হয়: আল-হাদিস।

৩। রমজানের শেষ রাতে সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হয়’: আল-হাদিস।

৪। রমজান জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল’: আল-হাদিস।

৫। রমজান প্রায়শ্চিত্তের অন্যতম মাধ্যম’: আল-হাদিস।

৬। রোজা কিয়ামতের দিন মুমিনের জন্য পথপ্রদর্শক হবে’: আল-হাদিস

৭। রমজান জান্নাতে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায় এবং রাইয়ান নামক বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ’: আল-হাদিস।

৮। আল্লাহ নিজ হাতে রোজার প্রতিদান দেবেন’: আল হাদিস।

৯। রোজার মাধ্যমে আচার-আচরণ সুন্দর হয়’: আল-হাদিস।

১০। রোজা মানুষকে পরকালের চিন্তার দিকে নিয়ে যায়’: আল-হাদিস।

১১। রমজান সামাজিক সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে’: আল-হাদিস।

১২। রমজান আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে একটি অত্যন্ত গোপন ইবাদত, তাই এটি আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সম্পর্ককে মজবুত করে”: আল হাদিস।

১৩। রমজান আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি অভূতপূর্ব প্রশিক্ষণ’: আল-হাদিস।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের জন্য রমজান মাসের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি রমজান মাসের রজনীতে ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদত করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের জন্য কদরের রাতে ইবাদত করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)

হাদিসে আরও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য। কিন্তু রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই পুরস্কৃত করব। রোজা (জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরুপ।

তোমাদের কেউ যেন রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তা ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়।

কেউ গালি দিলে বা তার সাথে ঝগড়া করলে সে শুধু বলবে, আমি রোজাদার।

সেই মহান সত্তার কসম যার হাতের তালুতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে কস্তুরীর সুগন্ধির চেয়েও বেশি প্রিয়।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, সে তার (রোজাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোজাদারের প্রতিদান থেকে বিন্দুমাত্র ও হ্রাস করা হবে না।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ৮০৭)

রোজাদারদের জন্য দু’টি খুশি – ইফতারের মূহুর্ত এবং আল্লাহর সাথে দিদারের মূহুর্ত। (বুখারী)।

 

রমজান সারা বছরের শ্রেষ্ঠ মাস

রাসুল (সাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজানের চেয়ে বেশি ক্ষতির কোনো মাস আসেনি। কেননা ঈমানদাররা এ মাসে (পুরো বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পথ সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা এতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষ খুঁজে পায়। এ মাস মুমিনের জন্য লাভ এবং মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদীসঃ ৮৩৬৮)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের প্রথম রাত এলে দুষ্ট জ্বীন ও শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, একটি দরজাও খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাগুলো খোলা হয়, একটি দরজাও বন্ধ হয় না। আর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে লাগলেন—হে কল্যাণকামী! হে মন্দ প্রার্থী! আল্লাহ তায়ালা এই মাসের প্রতি রাতে অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। (তিরমিযী, হাদীসঃ ৬৮২)

রমজান মাস বরকতময় মাস

আবু হুরায়রা (রা) বলেন, যখন রমজান মাস এল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের কাছে বরকতময় রমজান মাস এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর এ মাসের রোজা ফরজ করেছেন…’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৭১৪৮)।

রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। আবার রোজার বিনিময়ে অনেক বড় সওয়াবও ঘোষণা করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘রোজা আমার জন্য’। আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।আমার বান্দা আমার জন্য খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করে,কাম ত্যাগ করে।রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ।একটি আনন্দ ইফতারের সময়।আরেকটি আনন্দ ছিল আমার সাথে তার সাক্ষাতের সময়।রোজাদারের মুখের গন্ধ। আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধের চেয়েও উত্তম।” (বুখারি, হাদিস : ৭৪৯২)

এ মাসে মানুষের প্রতিটি আমল বৃদ্ধি পায়। একটি নেক্কি ১০ গুণ থেকে (কিছু ক্ষেত্রে) ৭০০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কারণ রোজা আমার জন্য। তাই আমি নিজেই তাকে তার প্রতিদান শোধ করব।’ (বুখারি, হাদিস: ১৮৯৪)

রোজাদারদের জন্য বিশেষ দরজা

রমজানের ফজিলত এত বেশি যে এই মাসে জান্নাতে একটি দরজা আছে। তার নাম রাইয়্যান। রোজাদাররা কিয়ামতের দিন সেই দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেই দরজা দিয়ে অন্য কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ঘোষণা করা হবে- “রোজাদাররা কোথায়?” তারপর তারা উঠবে। তারা ছাড়া আর কেউ যাবে না। জান্নাতে প্রবেশ করলে রাইয়্যানের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাই এই গেট দিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস: ১৮৯৬; মুসলিম, হাদিস: ১১৫২)

এবং যে কেউ রাইয়্যান গেট দিয়ে প্রবেশ করবে সে আর কখনও ক্ষুধার্ত বা পিপাসার্ত হবে না।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তি, যিনি উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম পালন করে, তার প্রথম পুরস্কার— রমজান শেষে গুনাহ থেকে ওই দিনের মতো পবিত্র হয়— যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৬৬)

দোয়া কবুল ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি

রমজানের ফজিলত অনেক। এ মাসে অনেক মানুষের দোয়া কবুল হয়। আবেদন মঞ্জুর করা হয়. জাহান্নামের তালিকা থেকে জাহান্নামের নাম বাদ, জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঘোষণা। তাই এ মাসে বেশি বেশি নেক আমল করা উচিত। তওবা করতে হবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইতে হবে। সকল আবেদন দয়াময় আল্লাহর দরবারে পেশ করতে হবে।

রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রমজানের প্রতি দিন ও রাতে বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।” আর প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি দোয়া কবুল হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদীসঃ ৭৪৫০)

হাদিসে আছে, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না : রোজাদারের দোয়া, ইফতার পর্যন্ত। ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। মজলুমের দোয়া।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৪২৮)

রমজান মাস পাপ মোচন ও গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে অন্য জুমা পর্যন্ত এবং এক রমজান থেকে অন্য রমজান পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহগুলোকে মুছে দেয় যদি সেই কবীরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে।” (মুসলিম, হাদিস : ২৩৩)

রমজানে বেশি বেশি দান করুন

রাসুল (সাঃ) প্রচুর দান করতেন। আর এ মাসে তিনি দানের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসুল আকরাম (সাঃ) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমজান মাসে তার দান-খয়রাত আরও বেড়ে যায়; যখন জিবরাঈল (আঃ) তার সাথে দেখা করতেন। জিবরাঈল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং তারা পরস্পর কোরআন শোনাতেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল। (মুসলিম, হাদিস : ২৩০৮)

রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোজাদারের সমান) সওয়াব পাবে। তবে রোজাদারের সওয়াব থেকে বৃন্দু পরিমানও কাটা হবে না।’ (তিরমিযী, হাদীসঃ ৮০৭)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে রমজানের ফজিলত ও রমজানের ফজিলত এর গুরুত্ব বুঝে তৎঅনুযায়ী আমল করার তৈফিক দান করুন। আমিন।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!