ইসলামী সংস্কৃতি
সমাজ বিজ্ঞানী এইচ.কে.লাস্কি সংস্কৃতি বলতে বুঝিয়েছেন: “Culture is what we are” অর্থাৎ আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলাে মানুষ হয়ে গড়ে উঠার আর্ট। অনবরত নিজেকে সৃষ্টি করা। অথবা বলা যায় ইসলামী সংস্কৃতি মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন বা মানুষের জীবনই সংস্কৃতি।
ছােট্ট একটা উদাহরণ দিই-
নীরা’র বাবা যখন ওকে প্রথম মােবাইল কিনে দেয় তখন সে দারুণ এক্সসাইটেট। ফোনটা দিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলাে। কথা বলতে বলতে কেমন যেন আসক্ত হয়ে গেল। মােবাইল কোম্পানীগুলাের ফ্রি’র ফাদে পড়ে সারারাত এর সাথে ওর সাথে কথা। মিথ্যা, প্রতারণা, চাপাবাজি আর্টে পরিণত করল। জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলল নীরা। নিজে অন্যের সাথে প্রতারণা করে, অন্যের দ্বারা প্রতারিত হয়ে অবশেষে নীরা কিছুটা শান্ত হল।
কিছুদিন পর যখন ইন্টারনেট আরও সহজলভ্য হল। ফেসবুকিং যুগের ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াল। নীরা তখন আবারও অস্থির। এভাবে নিত্যনতুন হুজুগের তােড়ে সে কোথায় ভেসে চলেছে নিজেই জানে না।
খাদিজার অবস্থা ঠিক উল্টো। তার মােবাইল ফোন আছে। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বশেষ সেবাগুলাে সে জানে এবং ব্যবহারও করে। তবে এসব প্রযুক্তি যেন অপব্যবহৃত না হয় ওর দ্বারা এ সম্পর্কে সে সচেতন। ফলে ও দক্ষ মানবসম্পদ হয়ে গড়ে উঠল। যার নিজের জীবনটাই শুধু আলােকিত নয় বরং অন্যদের আলােকিত করার যােগ্যতাও তার রয়েছে।
নীরা ও খাদিজার জীবনাচরণের মধ্যে এই যে পার্থক্য তার ভিত্তি হল তাদের বিশ্বাস। জীবন ও জগত সম্পর্কে তাদের মনে লালিত-পালিত চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তাদের জীবনাচরণ পরিচালিত হয়েছে।
ইসলামী সংস্কৃতি বলতে মানুষের এই জীবনাচরণকেই বােঝানাে হয় যার ভিত্তি হল বিশ্বাস। দুটি গাছের বীজকে যদি আমরা সামনে রাখি একটি নিম গাছের বীজ, আর একটি আম গাছের বীজ। নিম গাছের বীজ আর আম গাছের বীজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকার কারণে নিম গাছের শিকড় থেকে শুরু করে এর পাতা, এর ফল সবটাই আম গাছের মূল, শিকড়, পাতা, ফুল ও ফল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসকে একটি গাছের বীজের সাথে তুলনা করার মতাে। যার বিশ্বাস এই দুনিয়া কেন্দ্রিক, ইহ জগতকে কেন্দ্র করেই যার বিশ্বাসটা পরিচালিত হয়, জীবন ও জগতকে সে একভাবে গ্রহণ করে। আর যার বিশ্বাস এই দুনিয়া বা ইহলৌকিক জীবনটাই শেষ কথা নয়, এরপরও একটা জীবন আছে, তার চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারনা এবং জীবনাচরণ শুধুমাত্র ইহজাগতিকতায় বিশ্বাসী ব্যক্তির থেকে পার্থক্য হতে বাধ্য।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান আর ইসলামী সংস্কৃতি তার একটি অধ্যায়। যে ব্যক্তি দুনিয়াকে একটা চারণক্ষেত্র বলে মনে করে এবং জীবনটাকে শুধু পানাহার আর পার্থিব বিলাস-ব্যসনে পরিতৃপ্তি লাভের একটা অবকাশ বলে ধারণা করে সে জীবনভর শুধু ইন্দিয়কে পরিতৃপ্ত করার ভােগােপকরণ সংগ্রহের জন্যে চেষ্টা করতে থাকবে। ফলে তার সংস্কৃতির রূপটি হবে ভােগবাদী। দুনিয়ার জীবনে মানুষের বিভিন্ন পর্যায়, পরিস্থিতি ও জটিলতা উত্তরণে কোন দিকনির্দেশনা এ সংস্কৃতিতে পাওয়া যায় না। এখানে হয়ত মানবিকতা আছে তবে তা খণ্ডিত। আত্মকেন্দ্রিকতার দোষে দূষিত। যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর খলিফা এবং দুনিয়ার বুকে তার প্রতিনিধি বলে বিশ্বাস করে, স্বাভাবিকভাবেই তার লক্ষ্য হয় একজন প্রতিনিধি হিসেবে তার মালিকের সন্তুষ্টি ও ভালবাসা লাভ করা। দুনিয়ার জীবনে একজন উত্তম, অনুগত, বিশ্বস্ত ও কর্তব্যনিষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হওয়া যাতে দুনিয়া পরবর্তী জীবনে তার মালিকের পক্ষ হতে প্রতিশ্রুত উৎকৃষ্ট জীবন লাভ করতে পারে।
তার জীবনের স্বরূপটা হয় এমন-
“হে নবী, তুমি বলে দাও আমার নামায, আমার ইবাদাত, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবকিছুই সেই আল্লাহর জন্যে যিনি সমস্ত জগতের প্রভু এবং যার কোনই শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমিই তাঁর সামনে সর্বপ্রথম মস্তক অবনতকারী-আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা আনআম: ১৬২-১৬৩)।
এমন লক্ষ্যাভিমুখী ব্যক্তির জীবনাচরণে কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়:
১. এ ধরনের ব্যক্তির সকল প্রকার প্রয়াস-প্রচেষ্টা এবং সমস্ত ইচ্ছা-বাসনা ও আশা আকাক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তার প্রতিটি কর্মকাণ্ডই হয় আল্লাহর জন্য নির্ধারিত।
২. এই লক্ষ্যটি ইসলামী জীবনব্যবস্থায় যেমন একমুখিনতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে তেমনটি ব্যক্তিকেও চিন্তা-কল্পনায়, ইচ্ছা ও মননে এবং আকীদা ও আচরণেও এক পরিপূর্ণ একমুখিনতা এবং ভারসাম্য স্থাপন করে। বুদ্ধি ও মনােজগতের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে তার ভিতরে যেসব নব নব কামনা ও বাসনা সৃষ্টি হয় তারই ফলশ্রুতিতে সে নতুন নতুন জিনিসকে গ্রহণ করতে থাকে। ফলে মানুষের জীবন এক উদ্দেশ্য থেকে আরেক উদ্দেশ্যের দিকে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি যার লক্ষ্য এমন ব্যক্তি জ্ঞান ও বুদ্ধির যত উচ্চ মার্গেই থাকুক না কেন সে জানে আল্লাহর সত্ত্বা তার চেয়েও মহান ও উন্নত।
৩. এ লক্ষ্যের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে সাথে দুনিয়ায় ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক দিক দিয়ে মানুষের যতাে উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার সবই সে অর্জন করতে পারে। যেমন:
(i) দুনিয়ার জীবনে শান্তি, নিরাপত্তা, নিশ্চিন্ততা ও মানসিক প্রশান্তি।
‘জেনে রাখাে, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই আত্মার প্রশান্তি ও নিশ্চিন্তা লাভ হয়ে থাকে।” (সূরা রাদ: ১৮)
(ii) স্বাচ্ছন্দ্য অর্থাৎ দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগমুক্ত জীবন যে ব্যক্তি নেক কাজ করল মুমিন অবস্থায়- সে পুরুষ হােক আর নারী- আমরা তাকে অবশ্যই স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করাবাে। এমন লােকদেরকে আমরা নিশ্চিন্তরূপে তাদের আমলের চেয়ে বেশী উত্তম প্রতিফল দান করবাে।” (সূরা আন নাহল: ৯৭)
(iii) রাষ্ট্র ও শাসন ক্ষমতা এবং আধিপত্য ও উচ্চমর্যাদা: যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদার লােকদের বন্দু হয়েছে আর আল্লাহর দল অবশ্যই বিজয়ী হবে।’ (সূরা মায়েদা: ৫৬)।
(iv) পরকালীন জীবনে মুক্তি: ‘হে নিশ্চিন্ত নফস, আপন প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করাে, এমন অবস্থায় যেন তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তােমার প্রতি সন্তুষ্ট। অতপর আল্লাহ বলবেন যে, তুমি আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল এবং আমার বেহেশতে দাখিল হয়ে যাও।’ (আল ফজর: ২৭-৩০)
(v) তাকওয়া ও সৎকর্মশীলতার সর্বোত্তম প্রেরণা: ইসলাম পরহেযগারী ও সৎকর্মশীলতার যে উন্নত মান প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তার জন্য ন্যায় ও অন্যায়ের যে বিধি-নিষেধ পেশ করেছে- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে মানুষ এসব বিধি বিধান মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ হয়।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি- তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষের যে জীবনাচরণ গড়ে ওঠে এবং পরিচালিত হয় সেটাই ইসলামী সংস্কৃতি। আর তার মূল কেন্দ্রটি হচ্ছে- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। ইসলাম সংস্কৃতিকে কোন আলাদা সাবজেক্ট মনে করে না বরং সামগ্রিক জীবনাচরণের একটি সমন্বিত রূপ মনে করে। তাই এই সংস্কৃতির প্রভাব রাজনীতি, অর্থনীতিতে, মানুষের সামাজিকতায় অর্থাৎ মানুষের বিচরণের যত জায়গা, যত ক্ষেত্র, যত দিক ও যত বিভাগ আছে সবখানেই পরিব্যপ্ত। যারা ইহলৌকিক জীবনদর্শনে বিশ্বাসী এইসব জায়গায় তাদের আচরণ একরকম হবে। আর পারলৌকিক জীবনে যারা বিশ্বাসী, আল্লাহ প্রদত্ত নবী রাসূল (সা.) প্রদর্শিত আদর্শে যারা বিশ্বাসী, তাদের এই বিশ্বাস তাদের আচরণে একটা পৃথক বৈপরিত্যের বিকাশ ঘটাবে। তাদের সবকিছুতে একেবারে ঘর-সংসার, পরিবারপরিজনদের সাথে আচরণ, খাওয়া-দাওয়া, পেশাব-পায়খানা পর্যন্ত সর্বত্রই এ বিশ্বাসের বিকাশ ঘটবে।
ইসলামী সংস্কৃতি এমনই একটি পূর্ণাঙ্গ, সার্বজনীন ও শাশ্বত সংস্কৃতি
এ প্রসঙ্গে মাওলানা মওদূদী রচিত “ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা বইয়ের ভূমিকা অংশটি উদ্ধৃত করার লােভ সামলাতে পারলাম না। তিনি বলেন: ইসলামী সংস্কৃতির ব্যবস্থাপনা একটি রাজ্যের ব্যবস্থাপনার মত। এখানে আলাহ রাব্বুল আলামীন হলেন সর্বোচ্চ শাসক। রাসূল তার প্রতিনিধি। কুরআন তার আইন গ্রন্থ।
এ সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রস্তুত করা। এ হচ্ছে একটি ব্যাপক জীবন ব্যবস্থা যা মানুষের চিন্তা-কল্পনা, স্বভাবচরিত্র, আচার-ব্যবহার, পারিবারিক কাজকর্ম, সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড, রাজনৈতিক কর্মধারা, সভ্যতা ও সামাজিকতা সবকিছুর উপর পরিব্যপ্ত ।।
পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে এ সংস্কৃতি এক নির্ভুল সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে এবং এক সৎ ও পবিত্র জনসমাজ গড়ে তুলতে চায়। সমাজের লােকদের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র, আত্মানুশীলন, সত্যপ্রীতি, আত্মসংযম, সংগঠন, বদান্যতা, উদার দৃষ্টি, আত্মসম্ভ্রম, বিনয়- নম্রতা, উচ্চাভিলাস, সৎসাহস, আত্মত্যাগ, কর্তব্যবােধ, ধৈর্যশীলতা, দৃঢ়চিত্ততা, বির্যবত্তা, আত্মতৃপ্তি, নেতৃআনুগত্য, আইনানুবর্তিতার মত উৎকৃষ্ট গুণাবলী সৃষ্টি করতে চায়।
এ সংস্কৃতির প্রত্যয়বাদই দুনিয়ায় উৎকৃষ্ট গুণাবলী মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। এর মধ্যে মানুষের কর্মশক্তিকে সুসংহত করার এবং তাকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করার মতাে প্রচণ্ড শক্তি বর্তমান রয়েছে।
সুতরাং ইসলামী সংস্কৃতিকে সংকীর্ণভাবে বিবেচনার কোন সুযােগ নেই। বরং উদারতা বলতে যা বােঝায় তার ভিত্তি এটাই। ব্যাপকতা বলতে যা বােঝায় তার ভিত্তিও এটা। বিশ্বজনীন সার্বজনীন আদর্শ বলতে যা বােঝায় তার ভিত্তিও এটাই।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে ইসলামী সংস্কৃতির কল্যাণময়তা দ্বারা প্রতি ব্যক্তি ও সমাজকে উপকৃত হবার তাওফীক দিন। আমীন।