সুদ কাকে বলে ও ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ

সুদ কাকে বলে

সুদ কাকে বলে তা আজ আমরা নিচে উদাহরনের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যেমন-

স্বর্ণ দ্বারা স্বর্ণ বা উহার জেওর কিনিতে হইলে দুইটি বিষয় লক্ষ্য রাখিয়া কেনা উচিত। 

১ম, ওজনে সমান সমান কিনিতে হইবে। 

২য়, খরিদ্দার ও বিক্রেতা একই মজলিসে থাকিয়া বেচা-কেনা সম্পন্ন করিতে হইবে। নচেৎ সুদে পরিণত হইবে। 

যে সমস্ত বস্তু মাপিয়া বদলে বিক্রি করিতে হয়, যেমন: যদি এক গােস্তের, লােহার, তামার, তরকারির, ধানের, চাউলের, ময়দার, চাউলের গুড়ির ও পাটের বীজ ইত্যাদির পরিবর্তে অন্য গােস্ত, লােহা, তামা, তরকারি, ধান, চাউলের গুড়ি, ময়দা ও পাটের বীজ ইত্যাদি এক জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করিতে হয়, তবে উহা সমান সমান এবং নগদ-নগদ এক মজলিসে এওজ-বদল বা বেচা-কেনা করা ওয়াজেব। (একান্ত কর্তব্য), নচেৎ সুদ হইবে। (শামী)

 

অতএব বুঝা গেল যে, যদি কেহ এওজ-বদল বা সমান সমান বেচা-কেনার কথা মিটমাট করিয়া বলিল যে, আমি এখন একমণ ধান নিয়া যাইতেছি, কিছুক্ষণ পর আমার একমণ ধান আনিয়া তােমাকে দিয়া যাইব অথবা তুমি নিয়া আসিও; তথাপি সুদ হইবে। কেননা একস্থানে আদান-প্রদান হইল না। এইরূপে খারাপ ধান বা চাউল ইত্যাদি দিয়া ভাল ধান বা চাউল ইত্যাদি নিতে হইলেও সমান সমান এবং এক মজলিসে থাকিয়া আদান-প্রদান করা ওয়াজেব (কর্তব্য) হইবে, নচেৎ সুদ হইবে।

 

তবে সুদ হইতে বাঁচিয়া থাকিয়া বেশ-কম লইবার পন্থা এই যে, খারাপ বা ভালগুলির দাম লইয়া ঐ দামের পরিবর্তে অপরগুলি কিনিতে হইবে।

আর যদি এক জাতীয় দ্রব্য না হইয়া এক ওজনের হয়, তবে যত ইচ্ছা বেশ-কম লইতে পারিবে। যেমনঃ একমণ আলুর পরিবর্তে ১০ মণ ধানও লইতে পারিবে। কিন্তু এক মজলিসে আদান-প্রদান হওয়াই শর্ত (কর্তব্য), নচেৎ সুদ হইবে। অতএব, যে স্থলে বেচা-কেনা নির্ধারিত করা হইয়াছে, সে স্থলে এক জিনিস দিয়া অন্য স্থান হইতে অন্য জিনিস আনিয়া দিলেও সুদ হইবে। কারণ, ক্রেতা বিক্রেতার কথাবার্তার নির্ধারিত স্থান পরিত্যাগ করা হইয়াছে।

 

 আর যদি দুইদিকে দুই জিনিস হয় এবং এক জাতীয় ও এক ওজনের না হয়, তবে যত ইচ্ছা বেশ-কম কিনিতে পারিবে। যেমনঃ এক গজ কাপড় কিংবা একটি টাকা দ্বারা ১০ মণ ধান কিংবা ১০টি আনারস ইত্যাদি কিনিতে পারিবে। নগদ কিংবা বাকী উভয়ই দুরস্ত হইবে, সুদ হইবে না। 

যদি কোন স্ত্রী বা পুরুষ তাহার প্রতিবেশীর নিকট যাইয়া বলে যে, আমার ঠেকা, আমাকে এক খােরা (বাটি) চাউলের বা ময়দার আটা দাও, আমি ইহার পরিবর্তে এক খােরা চাউলের বা ময়দার আটা দিব অথবা দুই খােরা চিড়া দিব, তবে সুদ হইবে। কেননা, তাহার কথায় বুঝা যাইতেছে যে, সে বদ্লা-বদলি করিতেছে। সুতরাং বদ্লা-বদলি করিতে হইলে এক মজলিসে নগদ নগদ আদান-প্রদান হওয়া একান্ত কর্তব্য, নচেৎ এই সমস্ত ব্যাপারে সুদ হইয়া থাকে।

সুদ

 

 

ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ

সুদ একটি জঘন্য অপরাধ। জঘন্য এই অপরাধটি এখন এতটা ব্যাপক আকার ধারন করেছে যে, মানুষ এখন আর এটাকে কোন অপরাধই মনে করে না। এটা যে এক জঘন্যতম পাপ এই অনুভূতিটাও আজ শেষ হয়ে গেছে। অথচ এর পরকালীন শাস্তি ও আযাব খুবই দুর্বিষহ এবং ভয়ংকর। ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ একটি মারাত্বক অপরাধ এবং জগন্যতম পাপ। এই পাপ বা সামাজিক ব্যাধি রিতিমত আমাদেরকে পেয়ে বসেছে। আজ আমাদের সমাজ ধ্বংসের আরো একটি বড় কারন সুদী লেনদেন। আজ সমাজে এক শ্রেণীর লোক সুদের সাথে সম্প্রীক্ত হয়ে জরজরিত ও পথে বসে গেছে, অন্যদিকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের টাকায় বাহাদুরী করছে কেউ কেউ। আইয়্যামে জাহেলী যুগের মত আজও সেই সুদী ব্যবসায়ীরা সমাজে মাথা জাড়া ‍দিয়ে উঠেছে। সামাজিক ভাবে এদেরকে রুখতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ যে একটা বড় অপরাধ তা বুঝানোর জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আজ আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ যে কত বড় অপরাধ তা কুরআন ও হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা করার বা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

 

 

 

সুদ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বাণী

 ইরশাদ হচ্ছে-

‘সেই সব পরিমাপকারীদের জন্যে ধ্বংস-যারা অন্যদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় তাে পরিপূর্ণ নেয় আর তাদেরকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়ার সময় কম দেয়, তারা কি ভাবে না, তাদেরকে পুনরায় উত্থিত করা হবে এক মহান দিবসে- যে দিন সমগ্র মানব সারা জাহানের প্রতিপালক প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান থাকবে।’

 

হযরত রাসূলে কারীম (সা.) থেকে বর্ণিত আছে-

     ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদখাের, দাতা, লেখক ও সাক্ষীর প্রতি লা’নত করেছেন। বলেছেন, তারা সকলেই সমান অপরাধী।’

অন্য হাদীসে ইরশাদ করেন-

    ‘জেনে শুনে সুদের একটি দেরহাম ভক্ষণ করা ছত্রিশ বার যিনা করার চাইতেও  মারাত্মক।’ 

আরও বলেন-

   ‘যে শরীর প্রতিপালিত হয়েছে হারাম সম্পদে সেটা জাহান্নামেরই অধিক উপযুক্ত। 

আরও ইরশাদ করেন-

    ‘কেউ যদি কাউকে কর্জ দেয় তাহলে যেন কর্জগ্রহিতার কাছ থেকে কোন উপহার গ্রহণ না করে।’ (বুখারী শরীফ)

 

 

সুদের শাস্তি ও ভয়ংকর পরিণতি

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- মিরাজের রাতে আমি সপ্তম আকাশে প্রচন্ড গর্জন ও শব্দ শুনতে পাই। সেই শব্দের বিদ্যুতের চমকও দেখতে পাই। আরও কিছু লােক দেখতে পাই যাদের পেট ঘর-বাড়ির মত বিশাল বিশাল। পেটের ভেতর অসংখ্য বিচ্ছু। ভেতরের এই ভয়ংকর অবস্থা বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম। এরা কারা? জিবরাঈল বললেন, এরা হলাে সুদখাের

জনৈক ব্যক্তি বলেছে, যে শহরে ব্যভিচার এবং সুদী লেন-দেন হয় সে শহর ধ্বংস হয়ে যাবে।

হযরত আলী (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি ব্যবসা সম্পর্কিত শরীয়তের আইন-কানুন না শিখে ব্যবসা করবে, সে নির্ঘাত সুদী লেন-দেনে জড়িয়ে পড়বে। আর একারণেই হযরত উমর (রা.) বলতেন, যারা শরীয়তের মাসআলা-মাসাইল সম্পর্কে অজ্ঞ তারা যেন আমাদের বাজারে কেনা-বেচা না করে।

 

 

 চারটি ধ্বংসাত্মক বিষয়

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে সাবিত (রহ.) বলেছেন: যে সব অঞ্চলে এই চারটি বিষয় ব্যাপকতা লাভ করে সেসব অঞ্চল ধ্বংস হবেই। বিষয় চারটি হলাে- 

১. পরিমাণে কম দেয়া, 

২. ওজনে কম দেয়া, 

৩. ব্যভিচার ও 

৪. সুদখােরী।

যিনা-ব্যভিচারের কারণে মহামারী দেখা দেয়। মাপে ও ওজনে কম দেওয়ার ফলে বৃষ্টি কমে যায়। সুদী লেনদেনের ফলে মারামারি খুনাখুনি বেড়ে যায়। আজ কোন সমস্যাটি আছে যা আমাদের সমাজে নেই। আমাদের সমাজ এখন পাপের ভাগাড়। অথচ উল্লিখিত বাণী ও হাদীস শরীফ থেকে এটাই প্রতিভাত হয় যে, ব্যবসার মাসাইল না শিখে ব্যবসা করাই ঠিক নয়। আর ব্যস্তবতা হলাে, আমাদের সমাজের শতকরা ৯৯ জনে বা তার চেয়ে বেশি ব্যবসায়ী এমন যারা ব্যবসা সম্পর্কিত মাসাইল জানেও না এবং এর প্রয়ােজনের অনুভূতিটুকুও তাদের নেই।

এর চাইতেও দুঃখের বিষয় হলাে, অনেক ব্যবসায়ী তাে এমন আছে যারা শরীয়তের বিধি-বিধানকে এই কারণে সেচ্ছায় পাশ কাটিয়ে চলেন যে, এগুলাে জানলেই বরং সমস্যা। তারা মনে করে, এগুলাে জানলে তখন হালাল-হারামের পেঁচে পড়ে আর দুনিয়া কামাই করা সম্ভব হবে না। বড়ই দুর্ভাগা এই জাতীয় চিন্তা যারা করে তারা এবং যারা এই জাতীয় শব্দাবলী মুখে উচ্চারণ করে। তারা জানে না, কালই সমগ্র জাহানের মালিকের সামনে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, যেখানে পূর্ণ ইনসাফের সাথে বিচার করা হবে ।

 

 

 

সুদ থেকে মুক্তির উপায়

সুদ থেকে মুক্তির উপায় সমূহ নিন্মে উদাহরনের মাধ্যমে আলোচনা করা হল। সুদ হইতে বাঁচিতে হইলে নিম্নলিখিতরূপে বলিতে হইবে। যেমন: আমার ঠেকা সত্ত্বে বলিতেছি যে, আমাকে আজ এক খােরা আটা ধার দাও, আমি অন্যদিন ঐ পরিমাণ তােমার ধার শােধ করিয়া দিব, অথবা অমুক তারিখে শােধ করিব বলিয়া নিয়া যাইয়া ঠিক সেই তারিখে দুই খােরা চিড়া নিয়া হাজির হইয়া বলিল, অমুক দিনের ঐ এক খােরা আটার পরিবর্তে দুই খােরা চিড়া দিলাম। পাওনাদার গ্রহণ করিলেই সুদ হইবে না। কারণ, এখনে বদ্লা-বদলির কোনই কথা হইল না, বরং করজে-হাছানার ন্যায়ই হইল।

মূল কথা এই যে, এওজ-বদল বা বেচা-কেনায় নিম্নলিখিত চারিটি নিয়মের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া করিলে নিশ্চয়ই সুদ হইতে বাঁচিতে পারিবে।

১ম, এক জাতীয় ও এক ওজনের বস্তু, যেমন: ধানকে ধানের পরিবর্তে এওজ-বদল (বেচা-কেনা) করিতে হইলে সমান-সমান ও এক মজলিসে আদান-প্রদান করা কর্তব্য হইবে। অন্যথায় সুদ হইবে। (হেদায়া)

২য়, এক জাতীয় ও এক ওজনের বস্তু না হইলে, (যেমন: টাকা দ্বারা ঘােড়া কিনিতে হইলে) সমান সমান বা নগদ নগদ হওয়ার কোনই আবশ্যক করে না, সুদও হইবে না। (হেদায়া)

৩য়, এক জাতীয় হইয়া এক ওজনের না হইলে, (যেমন: বকরীকে বকরীর পরিবর্তে)।

৪র্থ, এক জাতীয় না হইয়া এক ওজনের হইলে, (যেমন: ধানকে সুপারীর পরিবর্তে)।

 

এই উভয় প্রকারের দ্রব্যের এককে অন্যের পরিবর্তে বিক্রি করিতে হইলে বেশ-কম যত ইচ্ছা করিতে পারিবে ; কিন্তু এক মজলিসে নগদ-নগদ আদান-প্রদান হওয়া চাই, অন্যথায় সুদ হইবে। সুতরাং এই চারটি নিয়মের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া দুনিয়ার যে কোন বস্তু বেচা-কেনা করিতে গেলে সুদ হইবে না। (আলমগীরী)

 

 

পরিশেষে

বলতে হয় যে, কোন জিনিস বিক্রি করিতে হইলে দোষ, নির্দোষ উভয় দেখাইয়া বিক্রি করিতে হইবে। দোষ ছাপাইয়া অথবা ফাঁকি দিয়া বিক্রি করা হারাম। খরিদান্তে দোষ প্রকাশ পাইলে খরিদ্দারের ইচ্ছানুযায়ী ফেরতও দিতে পারে, কিংবা উভয়ে রাজী হইয়া দাম কমাইয়া রাখিতেও পারে ; দুরস্ত আছে।– (দোররােল মােখতার)। 

কোন জিনিস কিনিতে দোকানদার ও গ্রাহক এইরূপ কথাবার্তা বলিল যে, এখন জিনিস নিয়া যাও বা যাইতেছি, হিসাব দেখিয়া দাম ঠিক করিব বা মিটমাট করিব, তবে এইরূপ বেচাকেনা দুরস্ত হইবে না। কারণ, এইরূপ কথাবার্তায় ঝগড়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

আজ আমরা চেষ্টা করেছি ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ’ এই শিরোনামে সুদের বয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করতে। আমার বিশ্বাস আপনারা যদি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন তাহলে তা ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। আম আমাদের লিখা তখনই স্বার্থক হবে যখন পাঠক এখান থেকে বৃন্দু পরিমান উপকৃত হয়। ভুল হলে ক্ষমা করবেন এবং লিখাগুলো কেমন হল তা কমেন্টস করে জানাবেন। আল্লাহ সবার মঙ্গল করুক। আমিন।।

 

বিস্তারিত আরও জানতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!