আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা

সামাজিক উন্নয়নে যাকাত

সামাজিক উন্নয়নে যাকাত

দ্বীন ও ঈমানের মধ্যে সজীবতা তখনই আসতে পারে যখন আলাহর ভালবাসা প্রত্যেক ভালবাসার উপর বিজয়ী হবে এবং দুনিয়ার চাহিদার উপর আখিরাতের চাহিদা অগ্রগামী হবে। যাকাত’ আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন এক বিধান যা একজন মুসলিমকে আল্লাহর ভালবাসার দিকে নিয়ে যায়। আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যাকাত এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিন্মে তা আলোচনা করা হলঃ

“অতএব আমি আমার রহমত ঐসব লােকদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যাকাত দেয় এবং যারা আমার আয়াতসমূহের উপর আস্থাবান।” (আল কুরআন)

 

যে গুণাবলীগুলাে হতে পারে একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজের ভিত্তি

সমাজের সর্বস্তরে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করার একটি রূপ হলাে সমাজের সকল মানুষের আর্থিক নিরাপত্তার বিধান করা। যাকাতের মাধ্যমে যে শক্তিশালী সামাজিক বলয় তৈরী হয় একমাত্র এর মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়ােজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টন এর ব্যবস্থা করা।

আল্লাহ সুবহানাওয়াতালা ইসলামের এ তাৎপর্যপূর্ণ বিধানটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমীন।

“এবং এসব লােক (আল্লাহর পথে) যা কিছু খরচ করে, তা এ অবস্থায় করে যে, তাদের দিল ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। তাদের মধ্যে এ ধারণা থাকে যে, তাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আল মুমিনুন : ৬০)

যাকাত

যাকাত হচ্ছে ইসলামী শরীয়াহ্ এর ৩য় স্তম্ভ। যাকাতের অর্থ পবিত্র হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া। ফিকাহ্ বিদদের মতে, যাকাত হচ্ছে একটি আর্থিক ইবাদাত।

“যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, নামায কায়েম করেছে এবং যাকাত দিয়েছে, তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে রয়েছে অনেক বড় প্রতিদান। (সূরা আল বাকারা ২:২৭৭)

নামায এবং যাকাত এ দু’টি বস্তু দ্বীনের আসল বাস্তব ভিত্তি। নামায আল্লাহর হক আদায়ের এবং যাকাত বান্দার হক আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা। যে ব্যক্তি যাকাতের হক আদায় করলাে, তার থেকে এ আশংকা করা যায় না যে, সে আল্লাহর বান্দাদের হক নষ্ট করতে থাকবে। দ্বীন ও ঈমানের মধ্যে সজীবতা তখনই আসতে পারে যখন আল্লাহর ভালবাসা প্রত্যেক ভালবাসার উপর বিজয়ী হবে এবং দুনিয়ার চাহিদার উপর আখিরাতের চাহিদা অগ্রগামী হবে। আল্লাহ তায়ালা এ আমলের মাধ্যমে মুমিনের অন্তর থেকে দুনিয়ার সকল প্রকার বস্তুগত ভালবাসা বের করে নিয়ে সেখানে তার আপন ভালবাসা বসিয়ে দিতে চান। এভাবে মুমিনের মধ্যে অর্জিত রুহানী শক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা। তবে এর জন্য প্রয়ােজন যাকাতের মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে যথাযথভাবে যাকাতের হক আদায় করা। এবং সামাজিক উন্নয়নে যাকাত কে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।

যাকাতের উদ্দেশ্য

সম্পূর্ন রূপে যাকাতের হক আদায় করতে হলে আমাদের জানা উচিত যে, যাকাত কেন ফরয করা হয়েছে এবং কি উদ্দেশ্য এর থেকে হাসিল করা যায়।

আল কোরআন ও সুন্নাহতে এ সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে যে, যাকাতের তিনটি উদ্দেশ্য একটি বুনিয়াদী ও ব্যক্তিগত এবং অন্য দুটি স্থানীয় ও সামাজিক।

১. আত্মশুদ্ধি

যাকাতের সত্যিকার এবং বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলাে অন্তরের পবিত্রতা অর্জন। যাকাত দাতার অন্তর দুনিয়ার লােভ-লালসা থেকে পাক হবে এবং পাক হওয়ার পর নেকী ও তাকওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাবে। আল কোরআনে বলা হয়েছে-

“জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে সেই ব্যক্তিকে যে আল্লাহকে ভয় করে এবং নিজের মাল অপরকে দান করে শুধুমাত্র পবিত্র হওয়ার জন্য।” (সূরা আল লাইল : ১৭-১৮)

২. অভাবগ্রস্তদের স্বচ্ছলতা বিধান

যাকাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্দেশ্যগুলাের মধ্যে একটি হলাে সমাজের নিঃস্ব লােকদের সাহায্য করা এবং তাদের মৌলিক প্রয়ােজন পূরণ করা। নবী করীম (সা.) বলেছেন-
“বস্তুত আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। এ যাকাত তাদের ধনবানদের কাছ থেকে নেয়া হবে এবং বিতরণ করা হবে তাদের মধ্যে যারা অভাবগ্রস্ত।” (মুসলিম)

 

৩. দ্বীনের সাহায্য

যাকাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্দেশ্যগুলাের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলাে দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য করা।

যাকাত ব্যবস্থা আসলে গােটা ইসলামী সমাজকে কৃপণতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, মনের কঠিনতা এবং শােষণ করার সূক্ষ্ম প্রবণতা থেকে পাক পবিত্র করে। এ কারণে যাকাত প্রত্যেক নবীর উম্মতের ওপর ফরয ছিল।

যাকাতের মূলনীতি

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। এটি এমন একটি বাস্তবসম্মত অর্থনীতি যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে যাকাতের মাধ্যমে কাক্ষিত কল্যাণ অর্জিত না হওয়ার কারণ হলাে যাকাত আদায় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে শরীয়াহর মূলনীতি অনুসরণ না করা। তাই কুরআন ও সুন্নাহর আলােকে যে মূলনীতিগুলাে পাওয়া যায় তা আমাদের জানা প্রয়ােজন।

প্রথমত: যাকাত আদায় প্রতিটি সাহেবে নিসাব মুসলমান নর ও নারীর জন্যে বাধ্যতামূলক। সাহেবে নিসাব মুসলমান তার প্রদেয় যাকাত আদায় না করলে যেমন আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে তেমনি ইহকালেও তাকে রাষ্ট্রের কঠোর কৈফিয়তের সম্মুখীন হতে হবে।

দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রই অর্থাৎ সরকারই যাকাত সংগ্রহ করবে তার নিজস্ব মেশিনারীর সাহায্যে। রাসূলে করীম (সা.) যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বড় বড় গােত্র প্রধানদের কাছে লােক পাঠাতেন। ঐসব নিয়ােগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আদায়কৃত অর্থ, গবাদিপশু ও খাদ্যশস্য এনে জমা দিতেন বায়তুলমালে। এরপর সেখান হতেই যাকাতের হকদারদের মধ্যে তা বিলি বণ্টন করা হত। এ কাজের জন্য ঐ সময় আট ধরনের কর্মচারী নিযুক্ত ছিল।

তৃতীয়ত: কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাতের প্রাপক হিসেবে যে আট শেণীর লােকের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যেই যাকাতের অর্থ সম্পদ বণ্টন করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে যাকাত হলাে কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়ােজন তাদের হক এবং তা দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হলাে আল্লাহর নির্ধারিত। বিধান।” (সূরা আত তাওবাহ : ৬০)

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সাতটি-
১, মুসলমান হওয়া;
২. নেসাবের মালিক হওয়া;
৩, নেসাব প্রকৃত প্রয়ােজনের অতিরিক্ত হওয়া;
৪, ঋণগ্রস্ত না হওয়া;
৫. মাল এক বছর স্থায়ী হওয়া,
৬. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া;
৭, বালেগ হওয়া।

 

যাকাতের বন্টন

একজন ব্যক্তি মূলধনের যে সর্বনিম্ন পরিমাণ মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরয় হয় সেই পরিমাণকে যাকাতের নেসাব বলা হয় এবং যে ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমান মূলধন থাকবে তাকে সাহেবে নেসাব বলা হয়। | একজন সাহেবে নেসাব ব্যক্তি যে হারে যাকাত আদায় করবেন তা নিম্নরূপ:

* কৃষিজাত ফসল উৎপন্নের জন্যে সেচ ব্যবস্থার প্রয়ােজন হলে উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ, বৃষ্টির পানিতে ফসল উৎপন্ন হলে তার এক-দশমাংশ।
* সঞ্চিত টাকা-পয়সা, সােনা-রৌপ্যর অলংকার এবং তেজারতি মালের শতকরা আড়াই ভাগ।
* বনে-জঙ্গলে চরে বেড়ানাে গৃহপালিত পশুর শতকরা দেড় থেকে আড়াই ভাগ।
• খনিজ পদার্থের শতকরা বিশ ভাগ।

 

অর্থনৈতিক ভারসাম্য

যাকাতের অন্যতম বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলাে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি। ধন আবর্তনশীল রাখার জন্যে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর সুবিধা ভােগের জন্যে ধনশালী ও পুঁজিপতিদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হয় এবং তা দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এতে করে ধন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর নিকট সঞ্চিত না থেকে সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে আবর্তনশীল হতে থাকে যা অর্থব্যবস্থার ভারসাম্য তৈরীতে সাহায্য করে।

সামাজিক উন্নয়নে যাকাত

 

যাকাত ও সামাজিক নিরাপত্তা

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সামাজিক নিরাপত্তার একটি প্রধান অংশ। যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

১. যাকাত হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রধান ভিত্তি। যাকাতের হকদার হচ্ছে যারা কর্মক্ষমতাহীন এবং যারা কর্মক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উপার্জনহীন অথবা পর্যাপ্ত উপার্জন করতে পারছে না। যাকাতের মাধ্যমে এই সব মানুষকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দান সম্ভব।

২ যাকাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন করা সম্ভব। রাষ্ট্রীয় তদারকিতে যাকাত অভাবগ্রস্তকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দিতে হবে যাতে সে আর অভাবগ্রস্ত না থাকে।

হযরত ওমর (রা.) এর মত হচ্ছে, “যখন দিবেই, তখন স্বচ্ছল বানিয়ে দাও।”

৩, যাকাত সূত্রে ব্যক্তির প্রদেয় অর্থ সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগৃহীত হলে বিশাল তহবিল গড়ে উঠতে পারে। সহস্র কোটি টাকা একত্রে পরিকল্পিতভাবে ব্যয়িত হলে যে বিশাল সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরি হবে তাতে সমাজের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক দুঃস্থ ব্যক্তির নিরাপত্তার বিধান সম্ভব।

যাকাতের অসাধারণ গুরুত্বও মহত্বের কারণে আল কোরআনে বিরাশি স্থানে এর তাগিদ দেয়া হয়েছে। সাধারণত নামায ও যাকাতের কথা এক সাথে বলা হয়েছে। নামায মানুষকে আল্লাহর ভালবাসার দিকে নিয়ে যায় এবং যাকাত তাকে দুনিয়ার দিকে যাবার জন্য নিরাপদভাবে ছেড়ে দেয় না। এই আর্থিক ইবাদতের মাধ্যমে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির সুযােগ পায় যা তার মধ্যে কিছু মৌলিক গুণাবলীর বিকাশ করে।

যাকাতের মাধ্যমে তৈরি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বলয় যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে দিতে পারে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মর্যাদা। যা বিশ্বের বুকে অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে। তবে এ জন্য প্রয়ােজন ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টন করা। তবেই সামাজিক উন্নয়নে যাকাত এর কার্যকারীতা শতভাগ পরিপূর্ণতায় রূপলাভ করবে।

পরিশেষে বলতে চাই সামাজিক উন্নয়নে যাকাত এর প্রভাবে সমাজ পরিবর্তিত হয়ে ক্ষুদা মুক্ত, দারিদ্র মুক্ত ও সচ্চলতার সমাজের রুপান্তরিত হোক এটাই আমাদের কাম্য। তো বন্দুরা আজকের আলোচনা আপনাদের কেমন লেগেছে তা কমেন্টস করে জানাবেন। এবং বেশি বেশি শেয়ার করতে ভুলবেন না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!