কিয়ামতের আলামত ও জাহান্নামের ভয়াবহতা

 কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে আমদের সবারই জানা দরকার। কিয়ামতের আলমত ও জাহান্নামের বয়াবহতা যে কত মারাত্মক হবে তা সম্পর্কে বেশি বেশি অধ্যায়ন করে সে অনুযায়ী আমল করে ইহকাল ও পরকাল উভয় জাহানের কামিয়াবী হাসিল করা সম্ভব। কিয়ামতের আলামত ও ভয়াবহতা এই প্রবন্ধে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। আমার বিশ্বাস আপনারা কিয়ামতের আলামত ও ভয়াবহতা এই প্রবন্ধটি পড়ে অনেক কিছু জানতে সক্ষম হবেন। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক……….

কিয়ামতের আলামত ও ভয়াবহতা

 

কিয়ামতের আলামত

কিয়ামতের আলামত সমূহ যখন পুরাপুরি ভাবে সম্পূর্ণ হবে তখন হযরত ইস্রাফিল (আঃ) শিঙ্গা মুখে নিয়ে অপেক্ষায় আছেন যে, কখন আল্লাহর হুকুম হবে এবং তিনি শিঙ্গায় ফুঁক দিবেন। তাঁর ফুঁক দেয়ার সাথে সাথেই সমস্ত জগত পর্যদস্ত হয়ে যাবে, লন্ড-ভণ্ড হয়ে পড়বে, সৃষ্টি জগতের মধ্যে আশ্চার্য ধরনের পেরেশানী দেখা দেবে। দ্বিতীয়বার ফুঁক দেবেন, তখন সমস্ত জগত ধ্বংস হয়ে যাবে, কয়েকজন ফেরেশতা ছাড়া সৃষ্ট জগতে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।

তখন আল্লাহু রাব্বুল ইজ্জত মালেকুল মউত কে বলবেন, এখন কে কে বাকি আছে। তিনি আরজ করবেন, জিব্রাঈল, মিকাঈল, ইস্রাফিল, আরশের বাহকগণ এবং আমি। তখন মালেকুল মউত কে হুকুম দেয়া হবে যে, তাদের আত্মাও কবজ করে নাও, সুতরাং তাদের সবার রূহও হরণ করে নেয়া হবে, তখন সৃষ্টি জগতের মধ্যে মালেকুল মউত ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। আল্লাহ তা’আলা বলবেন, মালেকুল মউত! এখন কে বাকী আছে? আরজ করবেন, এখন আপনি ছাড়া শুধু আমিই বাকী আছি। তখন হুকুম হবে, মালেকুল মউত! আমি ছাড়া সকলকে ধ্বংস হতে হবে, সুতরাং তুমিও মরে যাও। অতএব জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে তিনি নিজেই নিজের রূহ কবজ করবেন এবং এমন জোরে এক বিকট চিৎকার দেবেন যে, যদি তখন মাখলুক জীবিত খাকতাে, তাহলে তার চিৎকারের ভীম আওয়াজে সবাই মরে যেত। তখন তিনি বলবেন, যদি আমি জানতাম যে, মৃত্যুর সময় এত কষ্ট হয়, তাহলে মুমিনদের প্রাণ হরণ করতে আমি আরাে সহজ করতাম।

 

এখন আল্লাহু রাব্বুল ইজ্জত ছাড়া আর কেউ নেই, তাই এখন তিনি আল্লাহ বলবেন- আজকে বাদশাহরা, শাহজাদারা কোথায়? জালেমরা কোথায়? তাদের ঢেলারা কোথায়? ওরা কোথায়? যারা আমার খেত আর শয়তানের কাজ করত।  আজকের রাজত্ব কার?

 

সমগ্র জগত-ই তাে ধ্বংস, জবাব দেবে কে? তাই আল্লাহ তাআলা নিজেই বলবেন- আজকের রাজত্ব শুধু আল্লাহর। তিনিই এক এবং পরাক্রমশালী।

 

অতঃপর আসমান থেকে বীর্যের মত পানি বর্ষিত হবে, উদ্ভিদ-ঘাস গাছড়ার মত মানুষের দেহ জমীন থেকে বেরুবে, অতঃপর হযরত ইস্রাফিল (আঃ) কে জীবিত করা হবে, অনুরূপ হযরত জিব্রাঈল ও মীকাঈল আল্লাহিমাচ্ছালামকেও জীবিত করা হবে। তারপর ইস্রাফিল (আঃ) তৃতীয় বার শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন, ফলে সমস্ত মাখলুক জীবিত হয়ে যাবে । (সর্ব প্রথম হযরত রাসূল (সা) জীবিত হবেন) সমস্ত মানুষ উলঙ্গ হবে এবং এক আজীমুশশান ময়দানে সমবেত হয়ে যাবে।

 

আল্লাহ তা’আলা মাখলুকের প্রতি মােটেও দৃষ্টিপাত করবেন না, তাদের ব্যাপারে ফায়সালাও করবেন না। মাখলুক কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যাবে, চোখের পানি নিঃশেষ হয়ে যাবে, পানির স্থলে রক্ত বের হতে থাকবে এবং এত পরিমাণ ঘাম বেরুবে যে, অনেকের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে । এমন পরিস্থিতিতে হিসাব শুরু করার সুপারিশ করানাের জন্যে মানুষ নবীগণ (আঃ)-এর কাছে যাবে, সকলের অস্বীকার করার পর অবশেষে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) -এর কাছে আসবে। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন, তারপর হিসাব-নিকাশ শুরু হবে।

 

ফেরেশতাগণ কাতার বন্ধী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন, বলা হবে, সকলের আমল (কৃতকার্য) আমল নামায় লিখা আছে। যে ব্যক্তি ভাল আমল লিখা দেখবে, সে যেন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, আর যে ব্যক্তি খারাপ আমল লিখা দেখতে পাবে, সে যেন নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে। 

 

মানুষ ও জ্বিন ছাড়া অন্য প্রাণীদেরকে একে অপরের প্রতিশােধ করিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে। সেদিনকার দিনে টাকা পয়সার জরিমানা থাকবে না, বরং জালেমের নেকী মজলুমকে দিয়ে দেয়া হবে, নেকী শেষ হয়ে গেলেও যদি হক বাকী থাকে, তাহলে মজলুমের গুনাহ জালেমের মাথায় স্তুপ দিয়ে দেয়া হবে, যদ্দরূন অবস্থা এই দাড়াবে যে, অনেক বড় নেককার ব্যক্তির কাছে একটি নেকীও তখন থাকবে না, ফলে জালেমকে জাহান্নামে এবং মজলুমকে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। 

 

এত ভয়াবহ কঠিন দিন হবে যে, নৈকট্যশীল ফেরেশতা, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুচ্ছালাম ও শােহাদা (রাঃ) গণ পর্যন্ত নিজেদের নাজাতের সম্পর্কে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়বেন। 

 

পূর্ণ জীবনকাল, যৌবন, মাল-সম্পদ ও এলম প্রতিটির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। মানুষ নেকীর তালাশে পিতা-পুত্র বিবি প্রমূখ গণের কাছে যাবে, কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে আসবে। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত জিব্রাঈল (আঃ) হযরত রাসূল (সাঃ) -এর খেদমতে এমনভাবে আসলেন যে, ভয়ের কারণে তার চেহারার রং পরিবর্তন ছিল । ইতিপূর্বে কখনাে এমন অবস্থায় আসে নি। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন, জিব্রাঈল! আজ কি ব্যাপার, তােমার চেহারার রং পরিবর্তন কেন? আরজ করলেন, আজ জাহান্নামের এমন অবস্থা দেখে আসছি যে, যে কারাের এটা বিশ্বাস হবে, সে ততক্ষণ পর্যন্ত ধীর স্থির থাকতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজেকে এটা থেকে হেফাজত করে নেবে ।

 

রাসূলে করীম (সা) ফরমালেন, জিব্রাঈল! কিছু আমাদের কাছেও বর্ণনা কর। তিনি জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, আচ্ছা, তাহলে শুনুন!


জাহান্নামের ভয়াবহতা

 আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামকে সৃষ্টি করে এক হাজার বছর পর্যন্ত তাপ দিলেন, ফলে এটা লাল হয়ে গেল। অতঃপর হাজার বছর প্রজ্জলিত করলেন, ফলে সাদা হয়ে গেল, তারপর হাজার বছর পর্যন্ত তাপ দিলেন, যদ্দরূন কালাে হয়ে গেল, অতএব এখনাে এটা সম্পূর্ণ কালাে ও অন্ধকার আছে। এটার শিখা ও অঙ্গার কখনাে স্থিমিত হয় না।

 

আল্লাহর কসম, যদি সুঁই-এর ছিদ্র পরিমাণ জাহান্নাম খুলে দেয়া হয়, তাহলে সমস্ত জগত পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে ।

 

যদি কোন দোযখীর বস্ত্র আসমান ও জমিনের মাঝখানে লটকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে এটার দুর্গন্ধ ও তেজস্ক্রিয়ায় সমস্ত সৃষ্টিই ধ্বংস হয়ে যাবে ।

 

পবিত্র কুরআনে যে সমস্ত শিকল বা জিঞ্জিরের কথা উল্লেখ আছে, তন্মধ্যে যদি মাত্র একটি জিঞ্জির কোন পাহাড়ে রেখে দেয়া যায়, তাহলে তা গলে পাতাল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।।

 

যদি দুনিয়ার পূর্ব প্রান্তে কাউকে জাহান্নামের আজাব দেয়া যায়, তাহলে এটার ভয়াবহতায় পশ্চিম প্রান্তের অধিবাসীগণ কাঁপতে থাকবে। যার তেজস্ক্রিয়া খুবই তীব্র ও কঠিন এবং গভীরতা অন্তহীন আর এখানকার অলংকার হবে লােহার, পানি হবে গরম পুঁজ এবং কাপড় হবে আগুনের। 

 

এটার সাতটি দরজা থাকবে, প্রত্যেক দরজা দিয়ে নির্ধারিত নারী-পুরুষ প্রবেশ করবে।

 

রাসূলুল্লাহ (সা) প্রশ্ন করলেন, ওগুলাে কি আমাদের ঘরের দরজার মত হবে? আরজ করলেন, না, বরং এগুলাে স্তর বিশিষ্ট হবে এবং খােলা থাকবে । দু’দরজার মাঝখানে সত্তর বছরের রাস্তার দূরত্বের সমান হবে। প্রত্যেক দরজা একটি অপরটি থেকে সত্তর গুণ বেশী গরম ও উত্তপ্ত হবে।

 

আল্লাহর দুশমন, (অবাধ্যদেরকে) তাড়িয়ে ঐ দরজা সমূহের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, যখন দরজা পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন তাদেরকে জিঞ্জির (শিকল) দিয়ে অভ্যর্থনা জানানাে হবে, মুখে জিঞ্জির ঢুকিয়ে গুহ্যদ্বার দিয়ে বের করা হবে, অনুরুপ হাত-পা বেঁধে দেয়া হবে ।

 

প্রত্যেকের সাথে শয়তানও (যাদেরকে ওরা খােদা মনে করত) থাকবে, উপুড় করে হেঁচড়িয়ে ফেরেস্তারা লােহার হাতুড়ী দিয়ে পিটাতে, পিটাতে জাহান্নামে ঢুকাবে। তথা থেকে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে যখনই বেরুতে চাইবে, তখনই আবার ফেরৎ ঢুকিয়ে দেয়া হবে।

 

রাসূলুল্লাহ (সা) প্রশ্ন করলেন যে, ঐ দরজা সমূহে কোন ধরনের লােকেরা থাকবে তথা প্রবেশ করবে! আরজ করলেন, সর্ব নিম্ন দরজায় (স্তর) মুনাফিক, আল্লাহদ্রোহী ও ফেরআউনেরা থাকবে, সে স্তরের নাম হলাে, হাবীয়া ।

দ্বিতীয় স্তরের নাম হলাে জাহীম, এতে মুশরীকরা থাকবে। তৃতীয় স্তর হলাে ছাক্বার, তাতে ধর্মদ্রোহীরা থাকবে। চতুর্থ স্তরে ইবলিশ ও তার অনুসারীরা থাকবে, এটার নাম লাজা । পঞ্চম স্তর হুতামা, এতে ইহুদীরা এবং ষষ্ঠ স্তর সায়ীর-এ স্তরে নাসারারা থাকবে। অতঃপর হযরত জিব্রাইল (আঃ) চুপ হয়ে গেলেন । হুজুর পাক (সা) বললেন, চুপ হয়ে গেলেন কেন? সপ্তম স্তরে কারা থাকবে? বলুন! হযরত জিব্রাঈল (আঃ) কাকুতি-মিনতি ভরে বললেন, তথায় আপনার উম্মতের সেই সমস্ত লােকেরা থাকবে, যারা গুনাহে কবীরাহ করেছে এবং বিনা তওবায় মৃত্যুবরণ করেছে ।

 

একথা শুনে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) সহ্য করতে না পেরে বেহুশ হয়ে গেলেন । (আমার মা-বাবা তার জন্যে উৎসর্গ হােক) হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তার (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাথা মুবারক নিজ কোলে নিয়ে নিলেন। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুশে আসলেন। তখন বললেন, জিব্রাঈল! আমি বড়ই পেরেশানী ও চিন্তায় পড়ে গেছি। আমার উম্মতেরও কি কোন লােক কে আগুনে ফেলা হবে? আরজ করলেন, জী হ্যাঁ ! যদি কবীরাহ গুনাহকারী ব্যক্তি তওবা ব্যতীত মরে যায়। একথা শুনে হযরত রাসূল (সা) কাঁদতে লাগলেন ।।

 

হুজুর পাক (সা) ঘরে তাশরীফ নিয়ে গেলেন আর মানুষের সাথে মেলামেশা ছেড়ে দিলেন, শুধু নামাযের জন্যে মসজিদে তাশরীফ আনতেন এবং কারাে সাথে কথা-বার্তা না বলেই ঘরে চলে যেতেন। অবস্থা এই ছিল যে, কাঁদতে কাঁদতে নামায শুরু করতেন এবং ঐ অবস্থায়ই নামায শেষ করতেন। তৃতীয় দিবসে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) দরজায় হাজির হয়ে সালাম করলেন এবং প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, কিন্তু ভিতর থেকে কোন জবাব না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন।

 

অনুরুপ হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-ও আসলেন এবং কোন জবাব না পেয়ে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন । ইত্যবসরে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) ও এসে কখনো দাঁড়িয়ে ফেরত যান আবার ফিরে আসেন। এ অবস্থায় তিনি হযরত ফাতেমা জাহরা (রাঃ) এর দরজায় গিয়ে পৌছে গেলেন এবং সমস্ত ঘটনা শুনালেন ।

 

হযরত ফাতেমা (রাঃ) শুনা মাত্রই পেরেশান হয়ে গেলেন এবং তৎক্ষণাৎ চাদর মুড়ি দিয়ে সােজা দরবারে নববীর দিকে রওয়ানা হলেন। 

 

দরজায় পৌছে সালামের পর আরজ করলেন যে, আমি ফাতেমা! তখন হযরত রাসূল (সা) সেজদায় পড়ে নিজ উম্মতের জন্যে কাঁদছিলেন। মাথা মুবারক উঠিয়ে বললেন, আমার চোখের শান্তি ফাতেমা ! কি অবস্থা? (কেন এসেছাে, এই বলে) ঘরের লােকজনকে বললেন, দরজা খুলে দাও। হযরত ফাতেমা (রা) ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। তখন তিনি তাঁর রাসূল (সা)-এর অবস্থা দেখে তুমূল ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়লেন ।।

 

তিনি দেখলেন যে, রাসূল (সা)-এর অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে, রং হলদে বর্ণ হয়ে গেছে, চেহারার ঔজ্জ্বল্য মুছে গেছে। জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! আপনার কি পেরেশানী? আর আপনি কোন কথার চিন্তায় এত পেরেশান হয়েছেন? যদ্দরুন আপনার এই অবস্থা?

 

এরশাদ করলেন, ফাতেমা! আমার কাছে জিব্রাঈল (আঃ) এসেছিলেন, তিনি আমার কাছে জাহান্নামের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং বলেন যে, সবচেয়ে উপরের স্তরে আমার উম্মতের কবীরা গুনাহকারীরা থাকবে। এ চিন্তায় আমার এ অবস্থা হয়ে গেছে। হযরত ফাতেমা (রাঃ) আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা)! তাদেরকে কিভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করানাে হবে? ফরমালেন, ফেরেশতারা তাদেরকে জাহান্নামের দিকে টেনে-হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু তাদের চেহারা কালাে হবে না, চোখ নীলাভ বর্ণও হবে না। না তাদের মুখে মোহর লাগবে, না তাদের সাথে শয়তান হবে, তাদেরকে  জিঞ্জির দ্বারাও বাধা হবে না ।

 

হযরত ফাতেমা (রাঃ) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ফেরেশতারা কিভাবে টানবে? ফরমালেন পুরুষদের দাড়ি ধরে, মেয়েদের চুলের বেনী ধরে টেনে নেয়া হবে। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সবাই নিজেদের এহেন অপমান-অপদন্তের কারণে চিল্লা-চিল্লি করতে থাকবে । এ অবস্থায় যখন জাহান্নাম পর্যন্ত পৌছবে, তখন জাহান্নামের দারােগা ফেরেশতাদের বলবেন, এরা কারা? তাদের অবস্থা তাে! ভিন্নরূপ, আশ্চর্য ধরনের । তাদের চেহারাও কালাে নয়, চোখও নীল নয়, বাকশক্তিও রুদ্ধ নয়, শয়তানও সঙ্গে নেই, গ্রীবাদেশেও বন্ধন নেই এবং জিঞ্জির দিয়েও বাধা নেই ।

 

ফেরেশতাগণ বলবেন, আমরা কিছু জানিনা, আমরা হুকুম মুতাবিক তাদেরকে আপনার নিকট পৌছে দিলাম। তখন জাহান্নামের দারােগা তাদের বলবেন, আরে বদ বখতের দল! তােরাই বল যে তােরা কারা? (এক বর্ণনায় আছে যে, ওরা রাস্তায় “হায় মুহাম্মদ” বলতে বলতে যাবে কিন্তু জাহান্নামের দারােগাকে দেখা মাত্র হুজুর পাক (সা)-এর নাম ভুলে যাবে) ওরা বলবে, আমরা তারাই, যাদের উপর কুরআন নাযিল হয়েছিল এবং রামযানের রােজা ফরজ করা হয়েছিল ।

 

দারােগা বলবেন- কুরআন তাে শুধু হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর উপর নাযিল হয়েছিল । তখন তারা রাসূল (সা) এর নাম মুবারক শুনা মাত্রই চিৎকার করে বলবে, আমরা হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর উম্মত।

 

দারােগা বলবেন, পবিত্র কুরআনে কি আল্লাহর নাফরমানী সম্পর্কে তােমাদেরকে ভয় দেখানাে হয়নি? (সে মুহূর্তে) তারা জাহান্নামের দরজায় আগুন দেখে দারােগার কাছে আবেদন করবে, আমাদেরকে নিজেদের উপর কেঁদে নিতে দিন । সুতরাং (তখন) কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শেষ হয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যাবে।

 

তখন দারােগা বলবেন, আফসােস! এ কান্না যদি দুনিয়ায় হতাে, তাহলে আজ এ অবস্থা হতাে না। (তখন) দারােগার হুকুমে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দেয়া হবে। তখন সবাই সমস্বরে চীৎকার দিয়ে বলবে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এটা শুনে আগুন ফিরে যাবে, দারােগা আগুনের কাছে ফিরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আগুন বলবে, আমি তাদেরকে কিভাবে ধরবাে, যেখানে তাদের জবানে কালেমায়ে তাওহীদ জারী আছে। এমনটি কয়েকবার হবে।

 

অতঃপর দারােগা মালেক বলবেন, আল্লাহর হুকুম এটাই, তখন তাদেরকে আগুন ধরবে এবং কাউকে পা পর্যন্ত কাউকে হাটু পর্যন্ত, কাউকে কোমর পর্যন্ত, আর কাউকে গলা পর্যন্ত। যখন আগুন চেহারার দিকে আসবে, তখন দারােগা বলবেন তাদের চেহারা ও হৃদয়কে জ্বালাবে না, কেননা তারা দুনিয়ায় নামায়ে সেজদা করেছে, রমযানে রােজা রেখেছে। সুতরাং যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা, ততক্ষন এরা নিজেদের গুনাহর শাস্তিতে জাহান্নামে পড়ে থাকবে এবং বার বার আল্লাহকে (ইয়া হান্নানু, ইয়া মান্নানু, ইয়া আর-হামার রাহেমীন বলে) ডাকতে থাকবে ।

 

অবশেষে একদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে বলবেন, উম্মতে মুহাম্মদীয়ার খবর নাও তাে, দেখ! তাদের কি অবস্থা? তিনি (তখনি) দৌড়ে দোযখের দারােগার কাছে পৌঁছবেন, দারােগা তখন জাহান্নামের মধ্যস্থলে আগুনের মঞ্চে উপবিষ্ট থাকবেন । জিব্রাঈল (আঃ)-কে দেখা মাত্রই তিনি তার অভ্যর্থনায় দাড়িয়ে যাবেন এবং আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করবেন । হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বলবেন, আমি উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার অবস্থা দেখতে এসেছি, তাদের কি অবস্থা? তিনি জবাব দেবেন, বড়ই খারাপ অবস্থা, সংকীর্ণ জায়গায় পড়ে আছে, আগুনে তাদের শরীর জ্বালিয়ে দিয়েছে, তাদের গােশত খেয়ে ফেলেছে, শুধু চেহারা এবং হৃদয়টা বাকী আছে যেখানে ঈমান চমকাচ্ছে, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বলবেন, একটু আমাকেও দেখান।

 

হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে দেখা মাত্রই লােকেরা বুঝে ফেলবে যে, ইনি আজাবের ফেরেশতা নন, এত সুন্দর চেহারা আজ পর্যন্ত কখনাে দেখিনি।

 

তাদেরকে বলা হবে যে, ইনি হযরত জিব্রাঈল (আঃ), যিনি হযরত মুহাম্মদ মােস্তফা (সা)-এর কাছে ওহী নিয়ে যেতেন। এ লােকেরা এই মুবারক নাম শুনা মাত্রই চিৎকার করে বলতে থাকবেঃ হে হযরত জিব্রাঈল (আঃ)! আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ মােস্তফা (সা)-এর দরবারে আমাদের সালাম বলবেন, আর এটাও বলে দেবেন যে, আমাদের গুনাহ আমাদেরকে আপনার থেকে পৃথক করে দিয়েছে এবং বরবাদ করে দিয়েছে।

 

হযরত জিব্রাঈল (আঃ) ফিরে এসে আল্লাহ রাব্বুল কারীম এর দরবারে পুরা ঘটনা শুনাবেন। আল্লাহ তা’আলা ফরমাবেন, জিবাঈল! তারা তােমার কাছে কিছু বলেছে? বলবেন, জী হ্যাঁ ! হুজুর পাক (সা)-এর কাছে তাদের সালাম পেশ করতে এবং নিজেদের ধ্বংসাত্মক অবস্থা বর্ণনা করতে বলেছে ।

 

তখন হুকুম হবে, যাও! তাদের পয়গাম পৌছে দাও। এ হুকুম শুনা মাত্রই হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তৎক্ষণাৎ হুজুর (সা)-এর খেদমতে আসবেন, হুজুর পাক (সাঃ) তখন সাদা মূতির তৈরী এমন একটি মহলে আরাম করতে থাকবেন, যার চার হাজার দরজা হবে, প্রত্যেক দরজার উভয় পার্শ্ব স্বর্ণের হবে।

 

হযরত জিব্রাঈল (আঃ) সালাম শেষে আরজ করবেন, আমি আপনার গুনাহগার উম্মতদের কাছ থেকে এসেছি, তারা আপনাকে সালাম বলেছে এবং নিজেদের ধ্বংস ও দুর্বিসহ অবস্থার কথা আপনার কাছে পৌছাতে বলেছে (তারা নিতান্তই দুঃখ-কষ্টে নিমজ্জিত আছে)।

 

হুজুর পাক (সা) একথা শুনা মাত্রই আরশের নিচে গিয়ে সেজদায় পড়ে যাবেন এবং আল্লাহ পাকের এমন প্রশংসা করবেন, যা হুজুর পাক (সা)-এর আগে কেউই এমন ভাষায় প্রশংসা করতে পারেনি । তখন আল্লাহ পাকের হুকুম হবে যে, মাথা উঠান! বলুন, কি চান! অবশ্যই দেয়া হবে, যদি কারাে সম্বন্ধে সুপারিশ করতে চান, তাহলে সুপারিশ করুন মঞ্জুর করা হবে। তখন আল্লাহর দরবারে হুজুরে পাক (সা) আরজ করবেন, হে আমার পরওয়ারদেগার! আমার গুনাহগার উম্মতের উপর আপনার হুকুম জারী হয়েছে, তাদের গুনাহর শাস্তি দেয়া হয়েছে, এখন তাদের ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।

 

এরশাদ হবে, আমি আপনার সুপারিশ কবুল করে নিলাম, আপনি নিজে তাশরীফ নিয়ে যান এবং জাহান্নাম থেকে প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে বের করে আনেন, যে ব্যক্তি- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পড়েছিল।

 

সুতরাং হযরত রাসূল (সা) জাহান্নামের দিকে যাবেন।

 

দোযখের দারােগা হুজুর পাক (সা)-কে দেখামাত্রই তার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাবেন । হুজুর আকরাম (সা) দারােগার কাছে বলবেন, মালেক! আমার গুনাহগার উম্মাতের কি অবস্থা? তিনি বলবেন, খুবই খারাপ অবস্থা! তিনি রাসূল (সা)-কে দোযখের দরজা খােলার হুকুম দেবেন ।

 

যেই মাত্র জাহান্নামীরা হুজর আকরাম (সা)-কে দেখবে, তখনই চিৎকারে ফেটে পড়বে, বলবে- ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা)! আমাদের চামড়া, কলিজা সব আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন তিনি রাসুল (সা) সকলকে বের করবেন, সবাই কয়লার মত কালো হয়ে থাকবে, এ অবস্থায় তিনি রাসূল (সা) তাদেরকে জান্নাতের দরজায় বিদ্যমান ”নহরে রেজওয়ান” এ গােসল দেবেন। এতে তারা গোসল করে সুন্দর যুবক হয়ে যাবে । চেহারা চাঁদের মত চমকাতে থাকবে, কপালে লেখা হবে- (“এরা মেহেরবান আল্লাহর মুক্ত করা জাহান্নামী”) অতঃপর তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হবে ।।

 

এ সময় অবশিষ্ট জাহান্নামী পরিতাপ করে বলবে, আফসােস! আমরাও যদি মুসলমান হতাম, তাহলে তাে আজ আমাদেরকেও তাদের মত দোযখ থেকে বের করিয়ে নেয়া হত । এটাই পবিত্র কুরআন ঘােষণা করেছে-“অনেক কাফের (সেদিন)। আকাংখা করবে যে, তারাও যদি মুসলমান হতাে”। অতঃপর মৃত্যুকে একটি ভেড়ার আকারে এনে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের সামনে জবেহ করে দেয়া হবে এবং উভয়কে বলে দেয়া হবে যে, এখন থেকে আর কারাে মৃত্যু হবেনা, যে যেখানে আছে, সে সেখানেই চিরকাল থাকবে।

কিয়ামতের আলামত যে কত বয়াবহ তা আর বলে শেষ করা যায় না। কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে জেনে আপনাদের কেমন লাগছে কমেন্টস করে জানাবেন। কিয়ামতের আলামত ও জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি অধ্যয়ন করুন, পরকাল সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হওন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কিয়ামতের আলামত ও জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে তার উপর ভিত্তি করে বেশি বেশি আমল করার তৈফিক দান করুক। আমিন।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!