ঈদুল আজহা

কোরবানি মানে কারো কাছাকাছি হওয়া। ব্যাপক অর্থে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া। আল্লাহর বিধান মোতাবেক ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নিজের সম্পদ, সময়, শ্রম ও শ্রম কুরবানী করাকেও আল্লাহর পথে কুরবানী বলা হয়। ঈদুল আজহা ও কোরবানি অতপ্রত ভাবে জড়িত। আজ আমরা তার বিশদ বর্ননা নিন্মে আলোচনা করবো। 

আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব লাভের আশায় নির্ধারিত দিনে পশু জবাই করা হয়। কোরবানি শুধু একটি ত্যাগই নয়, আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শনও বটে। এই কোরবানিকে আল্লাহর সান্নিধ্যের মাধ্যম হিসেবে কুরআনের কয়েকটি আয়াতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ঐ নির্দেশাবলী কি?

আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, ‘কিন্তু মনে রেখো! কোরবানির রক্ত বা গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ সচেতনতা। এ জন্যই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেওয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবি! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭-৩৮)

ঈদুল আজহা

 

ঈদুল আজহা

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ঈদুল আযহার দিনে যাদের উপর যাকাত ফরজ অর্থাৎ যাদের সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ সম্পদ (যেমন সঞ্চিত অর্থ) আছে তাদের জন্য ঈদুল আজহা উপলক্ষে পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। ঈদুল আজহার দিন থেকে শুরু করে পরের দুই দিন পশু কোরবানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। ঈদুল আযহার নামাজের পর কুরবানী করতে হবে। ঈদুল আযহার নামাজের আগে কোরবানি দেওয়া ঠিক নয়।

বাংলাদেশের মুসলমানরা সাধারণত গরু-ছাগল কোরবানি দিয়ে থাকে। কেউ কেউ ভেড়া, মহিষ, উট ও দুম্বাও কোরবানি করে। গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা কোরবানি করা যাবে। তবে গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭টি ভাগে কোরবানি করা যাবে, অর্থাৎ ২, ৩, ৫ বা ৭ জনে গরু কোরবানি করতে পারবে। কোরবানির ছাগলের বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে। নিজ হাতে কুরবানী করা উত্তম। কোরবানির পশুটিকে দক্ষিণ দিকে কেবলামুখী করে রাখা হয় এবং ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করা হয়।

সাধারণত আমাদের দেশে কোরবানির গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, ১ ভাগ গরীব-দুঃখীদের মধ্যে, ১ ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং ১ ভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা হয়। তবে গোশত বণ্টনের সুস্পষ্ট নির্দেশ নেই কারণ পশু জবাই করার মাধ্যমে কোরবানির নির্দেশ পালন করা হয়। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ দান করার নির্দেশ রয়েছে।

প্রথম কোরবানি

কোরবানির ইতিহাস অতি প্রাচীন। কোরআনে হাবিল ও কাবিলের কাহিনী তারই প্রমাণ। ইসলামে এটাই প্রথম কোরবানি। হাবিলই প্রথম মানুষ যিনি আল্লাহর জন্য পশু উৎসর্গ করেছিলেন। ধর্মীয় বিবরণ অনুসারে হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কোরবানি করেন।

কোরবানি কবুলের নিদর্শন

তখন আল্লাহর নির্দেশিত বিধান বা পদ্ধতি ছিল যে, আকাশ থেকে আগুন নেমে আসবে এবং যার কুরবানী কবুল হবে তার জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। অর্থাৎ আগুন জিনিসটিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। তদনুসারে, বেহেশত থেকে নেমে আসা আগুন হাবিলের জবাইকৃত পশুর কুরবানী গ্রহণ করেছিলেন। পক্ষান্তরে কাবিলের ফসল হিসেবে যে কুরবানী করা হয় তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

কুরবানীর বিধান

পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা ইসলামের নবী ও রাসূল, মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে তার প্রিয় বস্তু কোরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর। হজরত ইব্রাহিম (আ.) নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ১০টি উট কোরবানি করেন। কিন্তু তিনি আবার কোরবানির আদেশ পান। তারপর আবার ১০০টি উট কুরবানী করলেন।

তারপরও তিনি একই আদেশ পেয়ে ভাবলেন, এই মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে পুত্র ইসমাইল (আ.)। এছাড়া আর কোন প্রিয় বস্তু নেই। অতঃপর তিনি হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য মিনারের দিকে রওয়ানা হন। হজরত ইব্রাহিম যখন তার ছেলেকে কোরবানি করার জন্য তার গলায় ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি অবাক হয়ে দেখেন যে ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি পশু কোরবানি করা হয়েছে এবং তার কোনো ক্ষতি হয়নি।

ঐতিহাসিক এই ধর্মীয় ঘটনার স্মরণে সারা বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর ঈদুল আজহা উদযাপন করে। ইসলামে, হিজরি ক্যালেন্ডারের ১২ তম চন্দ্র মাসকে জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কোরবানির সময় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই দিনে সারা বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেয়।

পশু কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। কোরবানি ইসলামের বিধান, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কোরবানি বা আযহাকে ইসলামী বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা পালন করা হয় পবিত্র ঈদুল আযহা উৎসবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানির মাধ্যমে। পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গায় কোরবানির ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ওঠে এসেছে। তাহলো-

১. আর আল্লাহর জন্য হজ ও ওমরাহ সম্পূর্ণ করুন। অতঃপর আটকে গেলে যে পশু সহজ হবে (জবেহ করা)। এবং যতক্ষণ না জন্তুটি তার সঠিক জায়গায় না পৌঁছায় ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা কামানো না। আর তোমাদের কেউ অসুস্থ হলে বা তার মাথায় কোনো ব্যথা থাকলে সে যেন রোজা বা সদকা বা পশু জবাইয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে। আর যখন তুমি নিরাপদ থাকবে, তখন যে ব্যক্তি উমরার পর হজ করার পর তামাত্তু করবে, তার জন্য সহজ পশু জবেহ করবে। কিন্তু যে তা পায় না, সে যেন তিনদিন রোজা রাখে, আর ফিরে এসে সাত দিন রোজা রাখে। এই পূর্ণ দশ. এই বিধান তাদের জন্য যাদের পরিবার মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জান! নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যান্ত কঠোর। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৯৬)

২. এবং তাদের কাছে আদমের দুই পুত্রের (হাবিল-কাবিল) কাহিনী বর্ণনা করুন, যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল। অতঃপর তাদের একজনের কাছ থেকে (কুরবানী) গৃহীত হয়েছিল, অন্যজনের কাছ থেকে নয়। তিনি বললেন, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। আরেকজন বললেন, আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের (কুরবানী) কবুল করেন। (সূরা মায়িদা : ২৭)

৩. বলুনঃ নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। ‘তার কোনো অংশীদার নেই এবং আমাকে তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর মুসলমানদের মধ্যে আমিই প্রথম। (সুরা আনআম : আয়াত ১৬২-১৬৩)

৪. ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্য বলিদানের বিধান করেছি; যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে সেসব পশুর ওপর যা তিনি তাদের জন্য দিয়েছেন। তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ; অতএব তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ কর আর সুসংবাদ দাও তাদেরকে যারা আনুগত্য করে, যাদের কাছে আল্লাহর বাণী উচ্চারিত হয়, তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা তাদের বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, যারা সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। ‘

৫. ‘আর আমি কোরবানির উটকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের একটি করে দিয়েছি; এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং তারা সারিবদ্ধ অবস্থায় তাদের উপর আল্লাহর নাম পাঠ কর। আর যখন তারা পড়ে যায়, তাদের থেকে খাও। যে সকল অভাবী মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে সকল অভাবী চেয়ে বেড়ায়- তাদেরকেও খেতে দাও। এভাবেই আমি ওগুলোকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৬)

৬. ‘অতঃপর যখন সে তার (ইব্রাহিম) সাথে চলার বয়সে উপনীত হল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বালক! তিনি (ইসমাঈল) বললেন, হে আমার পিতা! তোমাকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে তাই করো। ইনশাআল্লাহ, আপনি অবশ্যই আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। (সূরা আস সাফফাত: আয়াত ১০২)

৭. ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। এবং আমি একটি মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করেছি। আর সে জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে একটি সুনাম রেখেছি। ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। (সূরা আস সাফফাত: আয়াত ১০৬-১১০)

৮. ‘কিন্তু মনে রেখ! কোরবানির গোশত বা রক্ত ​​আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় কেবল তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ সচেতনতা। এ জন্য কোরবানির পশু আপনার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। কাজেই আল্লাহর নির্দেশনা দ্বারা তিনি আপনাকে যে কল্যাণ দান করেছেন তার জন্য তার মহিমা ঘোষণা করুন। হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দাও যে, আল্লাহ মুমিনদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৭-৩৮)

৯. ‘সুতরাং আপনার প্রভুর সন্তুষ্টির উদ্দ্যেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কোরবানি কর।’ (সূরা কাওসার : আয়াত ২)

ফলে কোরবানি মুসলমানদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট বিধান হয়ে দাঁড়ায়। হিজরি সনের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু জবাই করার ক্ষেত্রে এ নিয়ম পালন করতে হয়। এর মাধ্যমে মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ঈদুল আজহা তথা কুরবানীর সকল নিয়ম যথাযথভাবে পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x
error: Content is protected !!