আল-ইসলামের চতুর্থ রোকন হচ্ছে হজ্জ্ব। হজ্জ্ব হল গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, জান ও মালের ইবাদত। হজ্জ্ব কবুল হলে দুধের শিশুর মতো নিষ্পাপ বান্দা। তাই মুমিন হৃদয়ে হজ্জ্বর তামান্না ও কাবা দর্শনে চোখ শীতলের বাসনা অনেক বেশী। আল্লাহ যাকে কবুল করেন তাকেই পবিত্র ভূমি দর্শনে নিয়ে যান। শুধুমাত্র টাকা পয়সা নয়, চোখের পানির বদৌলতেও অনেক গরিব মিসকিন বান্দা আল্লাহর ঘর তওয়াফের সৌভাগ্য লাভ করে থাকেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করে থাকেন। নিন্মে আজকে আমরা হজ্জ্বের ফরজ ওয়াজিব সুন্নত সমূহ নিয়ে আলোচনা করবো।
হজ্জ্বের ফরজ ওয়াজিব সুন্নত
হজ্জ্বের ফরজ তিনটি। যথাঃ
প্রথমত: ইহরাম বাঁধা,
দ্বিতীয়ত: উকূফে আরাফাহ (আরাফার ময়দানে অবস্থান করা),
তৃতীয়ত: তাওয়াফে যিয়ারাত (চার চক্কর পরিমাণ)
ইহরাম বাঁধাঃ অর্থাৎ হজ্জ্বের নিয়ত করা। হে আল্লাহ! আমি হজ্ব উমরা এবং কাবাগৃহ তাওয়াফের জন্য নিয়ত করলাম। তুমি তা কবুল কর।
ইহরাম বাঁধার নিয়মঃ হজ্জ্ব ও ওমরাহর আমলগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম আমল হলো ইহরাম বাঁধা। ইহরাম বাঁধার নিয়ম হলো- হজ্জ্ব অথবা ওমরাহর নিয়তে সেলাইকৃত কাপড় খুলে সেলাইবিহীন দুটি চাদর পরিধান করে ‘তালবিয়াহ্’ পাঠ করা, শরিয়তের পরিভাষায় একেই ‘ইহরাম’ বলা হয়। ইহরাম বাঁধার উত্তম পদ্ধতি হলো-যখন ইহরাম বাঁধার ইচ্ছা করবে তখন প্রথমে গোসল অথবা অজু করবে, নখ কাটবে, বগল ও নাভীর নিচের চুল পরিষ্কার করবে এবং মাথা ও দাড়ি চিরুনি করে সর্ববিষয়ে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করবে। ইহরামের জন্য দুটি নতুন অথবা ধোলাই করা পরিষ্কার চাদর হওয়া সুন্নত। একটি চাদর দিয়ে লুঙ্গি বানাবে অন্যটি দিয়ে চাদর বানাবে। ইহরামের কাপড় পরিধান করার পর নামাজের মাকরুহ সময় না হলে মাথা ঢেকে দুই রাকাআত নফল নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। নামাজ পড়ে মাথার কাপড় খুলে ফেলবে এবং যেই হজ্জ্বের ইচ্ছা করবে মনে মনে সেই হজ্জ্বের নিয়ত করে ইহরামের ‘তালবিয়াহ্’ পাঠ করবে।
لَبَّيْكَ اللّهُمَّ لَبَّيْكْ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكْ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكْ ، لا شَرِيْكَ لَكْ
তালবিয়ার উচ্চারণঃ
‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা, লাকা ওয়াল মুল্ক লা-শারীকালাক’।
ওকূফে আরাফাহঃ জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ ফজরের পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা।
তাওয়াফে জিয়ারাতঃ অর্থাৎ মক্কা শরীফ পৌঁছার পর সর্বপ্রথম কাজটি হলো চারবার কাবাগৃহটি প্রদক্ষিণ করা আবার হজ্জ্বের কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরার সময় সর্বশেষ কাজ হলো তিনবার কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করে রওনা হওয়া।
হজ্জের ওয়াজিব সমূহ
হজ্জের মধ্যে ওয়াজিব কাজ মোট ৮টি। যথা-
১। মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধাঃ
ইবনু ‘আববাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাবাসীদের জন্য মীকাত নির্ধারণ করেন যুল-হুলায়ফাহ, সিরিয়াবাসীদের জন্য জুহফা, ইয়ামানবাসীদের জন্য ইয়ালামলাম ও নাজদবাসীদের জন্য ক্বারণ। উল্লিখিত স্থানসমূহ হজ্জ্ব ও ‘উমরাহ’র নিয়্যাতকারী সে স্থানের অধিবাসী এবং সে সীমারেখা দিয়ে অতিক্রমকারী অন্যান্য এলাকার অধিবাসীদের জন্য ইহরাম বাঁধার স্থান। আর যে মীকাতের ভিতরের অধিবাসী সে নিজ বাড়ি হতে ইহরাম বাঁধবে। এমনকি মক্কাবাসীগণ মক্কা হতেই ইহরাম বাঁধাবে। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং-১৫২৯,তাওহীদ পাবলিকেশন)
২। সূর্য্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করতে থাকাঃ
আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, অতঃপর তিনি উসামাহকে বাহনের পেছনে বসিয়ে মধ্যম গতিতে উষ্ট্রী চালিয়ে গেলেন। এ সময় লোকেরা তাদের উটকে ডানে-বামে মারধর করে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগলেনঃ শান্ত গতিতে চলো হে লোকেরা! অতঃপর সূর্য ডুবার পরই তিনি আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। (সুনানু দাউদ, হাদিস নং-১৯২২)
৩। আরাফার দিন শেষে ঈদের রাতটি ফজর পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা যতক্ষণ আকাশ প্রস্ফুটিত না হয়। তবে মহিলা ও দুর্বল পুরুষদের জন্য মধ্য রাতের পর মুযদালিফা ত্যাগ করা বৈধ আছে।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পরিবারের দুর্বল লোকদের আগেই পাঠিয়ে দিয়ে রাতে মুযদালিফাতে মাশ‘আরে হারামের নিকট উকূফ করতেন এবং সাধ্যমত আল্লাহর যিকর করতেন। অতঃপর ইমাম (মুযদালিফায়) উকূফ করার ও রওয়ানা হওয়ার আগেই তাঁরা (মিনায়) ফিরে যেতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ মিনাতে আগমন করতেন ফজরের সালাতের সময় আর কেউ এরপরে আসতেন, মিনাতে এসে তাঁরা কঙ্কর মারতেন। ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, তাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কড়াকড়ি শিথিল করে সহজ করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ১৬৭৬,তাওহীদ পাবলিকেশন)
৪। আইয়ামে তাশরিকেরঃ অর্থাৎ [১১.১২ ও ১৩ তারিখের ] রাত্রি গুলি মীনা এলাকায় কাটানো।
ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, ‘আববাস(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)পানি পান করানোর জন্য মিনার রাতগুলোতে মক্কায় অবস্থানের ব্যাপারে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭৪৫,তাওহীদ পাবলিকেশন)
৫। আইয়ামে তাশরিকের দিন গুলিতে তিন জামারাতেই কংকর তথা পাথর নিক্ষেপ করা।
ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, তিনি প্রথম জামরায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন এবং প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলতেন। তারপর সামনে অগ্রসর হয়ে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতেন এবং উভয় হাত তুলে দু‘আ করতেন। অতঃপর মধ্যবর্তী জামরায় কঙ্কর মারতেন এবং একটু বাঁ দিকে চলে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী দাঁড়িয়ে উভয় হাত উঠিয়ে দু‘আ করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। এরপর বাতনে ওয়াদী হতে জামরায়ে ‘আকাবায় কঙ্কর মারতেন। এর কাছে তিনি বিলম্ব না করে ফিরে আসতেন এবং বলতেন, আমি নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এরূপ করতে দেখেছি। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭৫১,তাওহীদ পাবলিকেশন)
৬। (দশ তারিখ ঈদের দিনে জামারাতুল আকাবাতে বা সর্ব শেষ বড় পাথর মারার স্থানে পাথর নিক্ষেপ করে) মাথার চুল মুন্ডন করা অথবা ছোট করা।
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা কামালেন এবং সহাবীদের একদলও। আর অন্য একটি দল চুল ছোট করলেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭২৯,তাওহীদ পাবলিকেশন)
৭। শুধু মাত্র ক্বিরান ও তামাত্তু হজ্জ্ব পালনকারীদের জন্য হাদয়ী তথা হজ্জ্বের কুরবানী করা।
আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কুরবানীর স্থানে কুরবানী করতেন। ‘উবাইদুল্লাহ (রহমাতুল্লাহ আলাইহি) বলেন, (অর্থাৎ) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরবানীর স্থানে। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং-১৭১০,তাওহীদ পাবলিকেশন)
৮। সকলের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা।
ইবনু ‘আববাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকেদের আদেশ দেয়া হয় যে, তাদের শেষ কাজ যেন হয় বাইতুল্লাহর তাওয়াফ। তবে এ হুকুম ঋতুমতী মহিলাদের জন্য শিথিল করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭৫৫,তাওহীদ পাবলিকেশন)
পবিত্র হজ্জ্বের সুন্নাত সমূহ
১। মিকাতের বাইরে থেকে আগত ইফরাদ ও কেরান হজ্জ্ব পালনকারীর জনু তাওয়াফে কুদুম করা। (ইফরাদ হজ্জ্ব পালনকারী মক্কা পৌছে এবং কেরা হজ্জ্ব পালনকারী ওমরার কার্য সসম্পাদন করে মাথার চুল না কেটেই তাওয়াফে কুদুম করবে।
২। তাওয়াফে কুদূমের পর যদি হজ্জ্বের সায়ী করার ইচ্ছা থাকে, তবে তাতে রমল ও ইযতিবা করা (আর তাওয়াফে কুদুমের পরে হজ্জ্বের সায়ী করার ইচ্ছা না থাকলে তাতে রমল ও ইযতিবা করতে হবে না।)
৩। সাফা মারওইয়ায় সায়ীর সময় সবুজ দুপিলারের মধ্যবর্তী স্থান পুরুষের জন্য দৌড়ে অতিক্রম করা এবং অবশিষ্ট স্থান হেঁটে চলা।
৪। ৮ই জিলহজ্জ বাদ ফজর মিনার উদ্দেশ্যে রওয়া হওয়া এবং তথায় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (নামায) আদায় করা। (ভিড় এড়াবার লক্ষ্যে বা অন্য কোনো কারণে ফজরের পূর্বে ও রাতে রওনা দেয়াও জায়েজ।)
৫। ৯ই জিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর মিনা হতে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। পূর্বে ও রাতে যাওয়াও দিবাগত রাত্রে মুযদালিফায় থাকা।(কোনো অসুবিধার কারণে বা ভিড় এড়াবার লক্ষ্যে বা অন্য কোনো কারণে ফজরের পূর্বে ও রাতে রওনা যাওয়াও জায়েজ।)
৬। আরাফা থেকে সুর্যাস্তের পর ধীরস্থীরভাবে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া।
৭। ৯ই যিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর আরাফা থেকে মুযদালিফায় এসে রাতযাপন করা। (উল্লেখ্য, মুযদালিফায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই কিছুক্ষণ উকুফ বা অবস্থান করা ওয়াজিব, সুবহে সাদিকের পূর্বে অবস্থান করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।)
৮। আরাফার ময়দানে গোসল করা।(তবে পানির পরিমাণ বুঝে গোসল করা উচিত। সামান্য পানি দিয়ে গোসল করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। কেউ কেউ আরাফায় পৌছে প্রচুর পানি অপচয় করে গোসল করে ও কাপড় ধুয়ে পানি শেষ করে ফেলে। ফলে কোনো কোনো ক্যাম্পে অযু, এস্তেঞ্জা ও খাবার পানি নিয়ে সকলকে সংকটে পড়তে হয়।)
৯। ৮ই যিলহজ্জ দিনগত রাতসহ মিনায় অবস্থানের দিনগুলোয়তে রাতযাপনও মিনাতে করা। উক্ত সুন্নতসমূহ থেকে কোনো সুন্নত স্বেচ্চায় ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। অবশ্য ছেড়ে দেয়ার দ্বারা সদকা ইত্যাদিও ওয়াজিব হবে না, তবে সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন আমলের মাঝে আরো অনেক সুন্নত রয়েছে, তার উল্লেখ যথাস্থানে রয়েছে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে পবিত্র হজ্জ্বের ফরজ ওয়াজিব সুন্নত ও নিয়ম কানুন মেনে সঠিক নিয়মে হজ্জ্ব পালনের যোগ্যতা দান করুন। আমিন।।